সময়ের সাহসি সন্তান মনোয়ার বখত নেক

প্রকাশিত: ৮:৪৬ পূর্বাহ্ণ, ডিসেম্বর ১, ২০১৯

সময়ের সাহসি সন্তান মনোয়ার বখত নেক

-শামসুল কাদির মিছবাহ-
মনোয়ার বখ্ত নেক-কে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেবার কিছু নেই।‘সুনামগঞ্জের নেক’ বললেই এক নামে সবাই তাঁকে চেনে। ১৯৯৮ সালের ১ ডিসেম্বর তিনি পরলোক গমন করেন। নেক ইহজগৎ ত্যাগ করলেও রয়ে যায় তাঁর অমর কীর্তি ও গৌরবগাঁথা ইতিহাস।
কীর্তিমান এই বীর পুরুষের জন্ম ১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারী সুনামগঞ্জ শহরের আরপিননগরে। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও ভাষা সৈনিক হোসেন বখ্ত এর ১০ পুত্রের মধ্যে দ্বিতীয় পুত্র তিনি। নেক এর অপর দুই ভাই আনোয়ার বখ্ত সুবাস ও শাহজাহান বখ্তও ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা। বলার অপেক্ষা রাখেনা, একই পরিবারে পিতা পুত্রসহ চারজন মুক্তিযোদ্ধা দেশের ইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত। সুনামগঞ্জের আদর্শ রাজনীতির আইকন, টানা দুইবারের পৌর মেয়র প্রয়াত আয়ূব বখ্ত জগলুল ছিলেন নেক এর সহোদর। আরেক সহোদর বর্তমান সুনামগঞ্জ পৌরসভার মেয়র নাদের বখ্ত। যাঁকে নেকের ছায়া হিসেবে অনেকে আখ্যায়িত করে থাকেন।
মনোয়ার বখত নেক ছিলেন বহুমুখী গুণের অধিকারী। তিনি ছিলেন একাধারে বীর মুক্তিযোদ্ধা, পৌর চেয়ারম্যান, রাজনীতিক, সংগঠক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। তাঁর নামের আগে বিশেষণ দিয়ে শেষ করা যাবে না। যা কিছু ভালো এমন সবকিছু গুণাগুণ ছিলো তাঁর মধ্যে। তবে সব কিছুকে ছাপিয়ে জনদরদী ও গরীবের বন্ধু হিসেবে অধিক সমাদৃত হয়েছিলেন।
নেক ছিলেন সময়ের সাহসী সন্তান ও অন্যায়ের প্রতিবাদীকণ্ঠ। ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তার অধিকারী সজ্জন এই মানুষটি গরীব, শ্রমিক মেহনতী মানুষের কাছে সবচেয়ে বেশি প্রিয়জন ছিলেন। আমৃত্যু ছায়া হয়ে থেকেছেন গরীর ও অসহায় মানুষের পাশে। জীবদ্ধশায় অগ্নিদগ্ধ মানুষকে বাঁচাতে গিয়ে নিজেই অগ্নিদগ্ধ হয়ে জীবন-মৃত্যুর সাথে দীর্ঘদিন পাঞ্জা লড়ে অকালে মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পন করেছেন। সড়ক ও জনপথের গোদামে অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটলে গোদামে আটকে থাকা মানুষজনকে উদ্ধার কাজে গিয়ে মারাত্বকভাবে অগ্নিদগ্ধ হন তিনি। দীর্ঘদিন চিকিৎসার পরও আর সুস্থ হয়ে উঠেননি। ১৯৯৮ সালের ১ ডিসেম্বর নিউইর্য়কের সিটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু বরণ করেন তিনি।
মনোয়ার বখত নেক এতোটাই জনপ্রিয় ছিলেন যে তাঁর এলাকা শহরের আরপিননগর হলেও তিনি প্রথম পৌর নির্বাচনে লড়েছিলেন শহরের (ষোলঘর-হাসননগর) এলাকা থেকে। পৌর পরিষদে কমিশনার পদে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়েছিলেন। পৌরসভার চেয়ারম্যান দেওয়ান জয়নুল জাকেরীন সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য ইস্তফা দিলে নেক কমিশনার পদ থেকে পদত্যাগ করে পৌরসভার উপনির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। সেই নির্বাচনে বিপুল ভোটে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৮৫ সাল থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত দক্ষতার সাথে সুনামগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন নেক।
নেক সম্পর্কে একটি ঘটনার বর্ণনা দেন শহরের ষোলঘরের বাসিন্দা, সুনামগঞ্জ ইমারত নির্মাণ কর্মী কল্যাণ সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মো. আব্দুল মুকিত। তিনি বলেন, সম্ভবত ১৯৮৩-৮৪ সালের দিকে তখন মনোয়ার বখত নেক ষোলঘর-হাছননগর এলাকা থেকে পৌরসভা নির্বাচনে কমিশনার পদে প্রার্থী হয়ে মাঠে প্রচারণায় নেমেছিলেন। মুকিত বলেন, এসময় আমি শহরের এইচএমপি হাই স্কুলের সামনে একটি কালভার্ট নির্মাণের কাজ করছিলাম। একদিন এক বৃদ্ধা বিলাপ করে কান্না করতে করতে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন ওই রাস্তা দিয়ে মনোয়ার বখ্ত নেক ও যাচ্ছিলেন। বিষয়টি তাঁর দৃষ্টিগোচর হয়। তিনি বৃদ্ধাকে থামিয়ে কান্নার কারণ জানতে চান।
তখন ওই বৃদ্ধা জানান, শহরের এক ব্যক্তির কাছ থেকে তাঁর ছেলে সুদে পাঁচ হাজার টাকা নিয়েছিলো। ওই টাকা বেড়ে বিশ হাজার টাকা হয়েছে। জমি বিক্রি করে পনেরো হাজার টাকা দিয়েছিলেন। বাকি টাকার জন্য তার ছেলেকে এখন বেঁধে রেখেছে। তখন মনোয়ার বখত নেক বৃদ্ধাকে সাথে করে নিয়ে ঘটনাস্থল থেকে তার ছেলেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন। এবং পাওনাদারকে আসল পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে সুদের পনেরো হাজার টাকাও ফেরত এনে বৃদ্ধার হাতে তোলে দেন। এসময় বৃদ্ধা খুশিতে আত্মহারা হয়ে নেককে প্রশ্ন করেন, বাবা তুমি কে? তখন নেক বলেন, আমি আপনার ছেলে। তখন ওই বৃদ্ধা বলেন, বাবা আমি তোমার জন্য দোয়া করি তুমি অনেক বড় মানুষ হও। আল্লাহ তোমাকে অনেক সম্মানের আসনে বসাবে।
ওই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী মুকিত আরো বলেন, ওই বৃদ্ধার দোয়া নিয়ে নেক চলে যাবার পর বৃদ্ধা আমাকে জিজ্ঞেস করেন, বাবা আমার এতো বড় উপকারটি যে করলো ওই লোকটির নাম কি? আমি জবাবে বললাম, উনার নাম নেক। তখন ওই বৃদ্ধা বললেন, বাবা আমি তো শুনেছি সুনামগঞ্জে এক নেক আছে সে মার-দাঙ্গা করে, লোকজনে তাকে ভয় পায়। তখন আমি বললাম উনিই সেই লোক। যাকে নিয়ে নিন্দুকেরা মিথ্যা অপপ্রচার করে। আপনাদের মতো গরীর অসহায় লোকদের যারা জুলুম-নির্যাতন করে নেক তাদের সাথে দাঙ্গা করে, অন্যায়ের প্রতিবাদ করে।
সুনামগঞ্জ ইমারত নির্মাণ কর্মী কল্যাণ সংগঠনের সভাপতি শাহজাহান গাজী বলেন, মনোয়ার বখত নেক ছিলেন সময়ের সাহসী সন্তান। গরীব, দুঃখী মেহনতী মানুষের আপনজন। ছিলেন ন্যায়ের প্রতীক। গরীব স্কুল ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ালেখার ব্যয়ভার বহনসহ গরীব রোগীর চিকিৎসার খরচও বহন করতেন তিনি। নেক সম্পর্কে বলে শেষ করা যাবে না। সুনামগঞ্জের যে ক’জন গুণী মানুষ ছিলেন নেক তাদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর মৃত্যুর পর সাধারণ মানুষ বুঝতে পেরেছে নেক কি ছিলেন। তিনি মেহনতী শ্রমিক মানুষের অন্তরে যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকবেন উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে।
কবি অ্যাড. রোকেশ লেইস বলেন, সুনামগঞ্জে যে ক’জন কীর্তিমান পুরুষ গত হয়েছেন মনোয়ার বখত নেক তাদের মধ্যে অন্যতম। নেক আমার বয়সে বড় হলেও চলেছি একই সাথে বন্ধুর মতো। আমি দেখেছি নেককে হিন্দু লোকের বেওয়ারিশ লাশ একা কাঁধে করে শশ্মানে নিয়ে যেতে। সাধারণ অন্য একজন মানুষ যে কাজটি করতে পারতো না, নেক সেখান থেকে শুরু করতেন। তাঁর কাছে না শব্দটি ছিলোনা। অনেক কঠিন কাজকে তিনি সহজে করতে পারতেন। বহু গুণে গুণান্বিত মানবিক মানুষ ছিলেন মনোয়ার বখত নেক। তাঁর মহৎ কাজের বর্ণনা বলে শেষ করা যাবে না।
বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান বলেন, মনোয়ার বখ্ত নেক আমার ঘনিষ্ট বন্ধু ও সহযোদ্ধা ছিলেন। তাঁর সম্পর্কে বর্ণনা দিলে শেষ করা যাবে না। আমি একটি ঐতিহাসিক ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছি। ১৯৭১ সালের ২৭মার্চ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর একটি দল ক্যাপ্টেন মাহবুবের নেতৃত্বে সুনামগঞ্জে আসে। প্রথমে থানায় প্রবেশ করে পুলিশদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করে। এর পর শহরে কিছু সময় ঘুরাফেরা করে শহরের পুরাতন সার্কিট হাউজে অবস্থান নেয়। এদিকে সংগ্রাম পরিষদ হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করার পরিকল্পনা গ্রহন করে। এবং চারদিকে খবর দেওয়া হয়। ২৮ মার্চ সকালে বিভিন্ন এলাকা থেকে জনগন এসে শহরে জড়ো হয়। হোসেন বখ্ত’র নেতৃত্বে একদল বাজারে অবস্থান নেয়। এদিকে হুমায়ূন কবির চৌধুরীর নেতৃত্বে হাছননগর বুবির পয়েন্ট থেকে অপর একটি দল মিছিল সহকারে সার্কিট হাউজ অভিমুখে রওয়ানা হয়। বাজার থেকে যে মিছিলটি এসেছিলো তারা স্বশস্ত্র ছিলো। ওই মিছিলে মনোয়ার বখ্ত নেকও ছিলেন। তাঁর হাতেও রাইফেল ছিলো। দু’দিক থেকে আসা দল থানার সামনে এসে একত্রিত হয়। বর্ডার থেকে ইপিআর আসার অপেক্ষায় সবাই। পরিকল্পনা ছিলো প্রশিক্ষিত ও স্বশস্ত্র ইপিআর আসার পর প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হবে। কিন্তু নেক এর সেই ধৈর্য্য সইছে না। নেক সরকারি জুবিলী হাই স্কুলের সামনে এসে সার্কিট হাউজ লক্ষ করে রাইফেল থেকে গুলি ছুড়েন। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সাথে শুরু হয় যুদ্ধ। এই যুদ্ধের সূচনায় ছিলো নেক এর অগ্রণী ভূমিকা। এই দুঃসাহসী কাজটি তিনি করেছিলেন। এই ঘটনাটি আমাকে আন্দোলিত করে। এছাড়াও আরো অনেক দুঃসাহসী ঘটনা রয়েছে নেক এর জীবনে। নেক ছিলেন দুঃসাহসী জননেতা। দেশ ও জনগণের জন্য তিনি জীবন বাজি রেখেছিলেন। মূলত সুনামগঞ্জে প্রতিরোধ যুদ্ধের সূচনাটাই তিনি করেছিলেন।
লেখক- গল্পকার ও সাংবাদিক


মুজিব বর্ষ

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

Pin It on Pinterest