গা ঘষা মাজুনি তৈরি করে হস্তশিল্পে সফল উদ্যোক্তার স্বপ্ন পূরণ করতে চায় বাগাতিপাড়ার কামরুল

প্রকাশিত: ১১:২৬ পূর্বাহ্ণ, অক্টোবর ২৮, ২০২০

গা ঘষা মাজুনি তৈরি করে হস্তশিল্পে সফল উদ্যোক্তার স্বপ্ন পূরণ করতে চায় বাগাতিপাড়ার কামরুল

এস ইসলাম, নাটোর জেলা প্রতিনিধি।

ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল মনে নতুন কিছু করার। সেই স্বপ্ন আর আত্মবিশ্বাস থেকেই পথ চলা। মাঝপথে প্রতিবন্ধকতা, তারপরেও হতাশায় রাতের ঘুম নষ্ট না করে আগামী দিনের সোনালী স্বপ্নকে বুকে লালন করে অবশেষে সফল উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন পূরণ করেছে আত্ম-প্রত্যয়ী কামরুল। ছোটবেলায় অভাব-অনটনে লেখাপড়া করতে না পারা সেই ছেলেটির স্বপ্ন বুনন শুরু হয় তখন থেকেই। তারপরে আস্তে আস্তে অভীষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে চলা। এক সময় কাজে ব্যাপক সাড়া পেলেও মাঝপথে আবার থমকে যাওয়া। ধীরে ধীরে স্বল্প পরিসরে আবারো কাজ শুরু করা। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে।

বলছি নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার ১নং পাকা ইউনিয়নের গালিমপুর পারকুঠী গ্রামের নাজিমুদ্দিনের ছেলে হস্তশিল্পে সফল উদ্যোক্তা কামরুলের সাফল্যের কথা। অটল আত্মবিশ্বাস নিয়ে কামরুল প্রথম কাজ শুরু করেন ২০১৪ সালের শেষের দিক থেকে। মাঝে কিছুদিন কাজ বন্ধ থাকলেও বর্তমানে বেশ ভালোই চলছে তার খোসা (গা ঘষার মাজুনি) তৈরি হস্তশিল্পের কাজ। প্রতিদিন প্রায় হাজারো অভাবগ্রস্ত নারী এই শিল্পের সাথে নিজেদের যুক্ত করে সচ্ছলতার মুখ দেখছেন।

জীবন সংসারে যুদ্ধ করে ভাগ্যের চাকা ঘোরানো অদম্য এই ব্যক্তির মনের আশা পূরণ হয় ২০১৫ সালে এসে। যেখানে অনেকেই উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে প্রয়োজনীয় অর্থ লগ্নি করে উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ শুরু করতে হিমশিম খায় বা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে হন্য হয়ে চাকরি খোঁজে সেখানে মাত্র স্বাক্ষর-জ্ঞান সম্পন্ন হয়েও তিনি হয়েছেন একজন খোসা তৈরি হস্তশিল্পের সফল উদ্যোক্তা।

সরজমিনে দেখা যায়, নাটোরের বাগাতিপাড়ায় বিভিন্ন স্থানে রয়েছে কামরুলের হস্তশিল্পের ব্যবসার প্রসার। গ্রাম্যবধূ, আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীগণ তাদের নিজ নিজ বাড়িতে বসেই নিপুণ হাতে তৈরি করেন এই খোসা। এ ছাড়াও যারা অলস সময় বসে না থেকে সময় কে কাজে লাগাতে চান, তারাও যোগ দিতে পারেন এই হস্তশিল্পে। প্রতিনিয়তই তৈরি হচ্ছে রং বেরংয়ের সুতা দিয়ে গা ঘষা মাজুনি বা খোসা। মনের মাধুরী মিশিয়ে তৈরি করা হচ্ছে গোসল সহ হাত-পা, মুখমণ্ডল পরিচ্ছন্ন করার প্রয়োজনীয় এই উপকরণটি। যা ছড়িয়ে পড়ছে দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় এমনকি দিন দিন বিদেশেও এর চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমাজের অবহেলিত তৃতীয় লিঙ্গের মানুষও স্বেচ্ছায় বিক্রি করতে এগিয়ে আসছে দরকারি এই পণ্যটি। এতে করে অলস সময় বসে না থেকে কাজ করে উপরি কিছু অর্থ আয় করতে পারছেন সমাজের পিছিয়ে পড়া অবহেলিত এই জনগোষ্ঠী।

হস্তশিল্পের এই সফল উদ্যোক্তা জানান, “আমার দুই সন্তান স্কুলে পড়ে। সেখানে অভিভাবক আছেন যারা স্কুলে বাচ্চাদের রেখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকেন। আমি সেখানকার অনেক অভিভাবকদের ফ্রি প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের এই অবসর সময়টা কাজে লাগাতে সক্ষম হয়েছি। তারা যখন সময় পান হাতের কাজ করেন। ফলে এই অবসর সময়ে কিছু বাড়তি টাকাও আয় হচ্ছে তাদের”।

পরিচিতির অভাবে পণ্যের সঠিক মূল্য পাচ্ছেন না বলে, কিছুটা হতাশ কামরুল ইসলাম বলেন, “আমার কাছ থেকে পণ্য নিয়ে বিভিন্ন মেলায় বিক্রি করে অনেক ব্যবসায়ী। আবার অনেকে বিদেশেও নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু অক্লান্ত পরিশ্রমের পর আমরা অনেক ক্ষেত্রে কর্মীদের ন্যায্য মজুরিও দিতে পারছি না। সরকার দেশের বিভিন্ন ব্যাংক ও দাতা সংস্থার মাধ্যমে নানা সহযোগিতা দিচ্ছে উদ্যোক্তাদের। সে দিক থেকে আমি এখনও বঞ্চিত। এজন্য সরকারী বেসরকারি কর্তৃপক্ষের নিকট আমার আকুল আবেদন স্বল্প সুদে ঋণ প্রদান এবং উৎপাদিত পণ্যের মান যাচাই করে বাজারজাত করণে আমার মতো একজন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার পাশে দাঁড়িয়ে গ্রামীণ এই শিল্পকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করেন । পাশাপাশি আমাদের তৈরি হস্তশিল্প দেশ বিদেশের ক্রেতা ও ব্যবসায়ীদের পরিচয় করিয়ে দেন।

ছোট বা মাঝারি যেকোনো শিল্পেই উদ্যোক্তাদের মুখোমুখি হতে হয় নানা ধরনের প্রতিকূলতার। মূলধনের সঙ্কট তো রয়েছেই। এজন্য সব কিছু পিছনের ফেলে এগিয়ে আসার আহ্বান খোসা তৈরি হস্তশিল্পে সফল উদ্যোক্তা কামরুলের। সফল এই উদ্যোগীর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সমাজে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী বিশেষ করে নারী ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের দক্ষ কর্মী হিসেবে গড়ে তুলতে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা। সেজন্য সরকারী বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও সমাজের বিত্তবানদের সহযোগিতা চান তিনি।

কামরুলকে সাধুবাদ জানিয়ে তার প্রতিবেশী, সমাজসেবী মহিদুল ইসলাম মনি বলেন, নিঃসন্দেহে সে একটি ভালো উদ্যোগ নিয়েছে। আমরা তার পাশে আছি, অনেক মানুষ আছে যারা উচ্চ শিক্ষিত হয়েও এমন বড় উদ্যোগ নিতে ভয় পান কিন্তু সে দিক দিয়ে কামরুল ভয় কে জয় করে এগিয়ে যাচ্ছে। আমি সব সময় তার সাফল্য কামনা করি।

হস্তশিল্পের এই সফল উদ্যোক্তাকে নিয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার প্রিয়াংকা দেবী পালের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি এই বিষয় টিকে ইতিবাচক হিসেবে গ্রহণ করেন। পাশাপাশি এই উদ্যোক্তাকে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সহযোগিতার আশ্বাসও দেন তিনি।

উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অহিদুল ইসলাম গকুল হস্তশিল্পের এই প্রতিষ্ঠানটি পরিদর্শন করবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, কামরুলসহ উপজেলার যে কোনো উদ্যোক্তা আমাকে পাশে পাবেন সব সময়। তাদের যেকোনো সমস্যা আমাকে বললে যেটুকু পারি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেব ইনশাল্লাহ।


মুজিব বর্ষ

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

Pin It on Pinterest