একজন বেলালের কথা

প্রকাশিত: ৪:১৭ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২২

একজন বেলালের কথা
 শর্বরী গোমস্তা, ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময় পূর্নিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি। হায়রে দারিদ্রতা, হায়রে অভাব। অসহায় মানুষের জীবনের বাস্তব চিত্র সরসরি না দেখলে উপলব্ধি করা যায় না। আমি শর্বরী গোমস্তা চাকুরীতে যোগদান ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১০ খ্রি: আমি যে বিদ্যালয়ে যোগদান করি ৮নং দেশান্তরকাঠী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। বিদ্যালয়টির অবস্থান বরগুনা জেলার বেতাগী উপজেলায়। আমারা ওই বিদ্যালয়ে ৮ জন শিক্ষক কর্মরত ছিলাম। বয়সের বিবেচনায় আমি ছিলাম সর্ব কনিষ্ঠ। তাই সকলের ছোট হিসেবে অন্যান্য শিক্ষকের কাছে খুবই স্নেহ পেতাম। চাকুরি জীবনের সূচনা বিধায় বিদ্যালয়ের অনেক নিয়ম-কানুন আমি জানতাম না বা বুঝতাম না। কিন্তু অন্য স্যারদের কাছে জানতে বা বুঝতে চাইলে আমাকে সবাই খুব সুন্দর ভাবে বুঝিয়ে দিতেন। চাকরীর কিছুদিন পর অর্থাৎ ডিসেম্বর মাসের শেষের দিক আমাদের বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ ইউনুচ আলম স্যার সবাইকে বললেন আগামী কালকে শিশু জরিপে যেতে হবে। আমি বুঝতে না পেরে স্যারকে বললাম স্যার শিশু জরিপ কি? তিনি অত্যন্ত সুন্দর করে জরিপ সম্পর্কে ধারনা দিলেন। বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আমার সাথে বন্ধুর মত আচরন করত। আর সে সব বিষয় আমি বেশ উপভোগ করতাম। আমার চাকুরীর বয়স তখন মাত্র ২ বছর যেতে না যেতেই আমি সি ইন এড প্রশিক্ষন শেষ করে পুনরায় আমার পূর্বের কর্মস্থলে যোগদান করি। কিছুদিন ক্লাশ করার পর আমার চোখ পড়ল তৃতীয় শ্রেনির এক শিক্ষার্থীর উপর। ক্লাশের সকলের চেয়ে লম্বা, গায়ের রং ফর্সা, কিন্তু পাতলা সেই ছেলেটির উপর। আমার মনে হলো ও ঠিকমতো তিনবেলা খেতে পায় না। প্রথম দুই-চার দিন কিছুই বলে ওর কষ্টগুলো অনুভব করতে চেষ্টা করলাম। আমি একা একাই মনে মনে ওই ছেলেটির বিভিন্ন দিক নোটিশ করলাম। ওর সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে বদ্ধপরিকর হলাম। ও কেন এতটা চুপচাপ থাকে? ওর অসহায় মুখটা দেখলে বার বার মনে হতো ও হয়তো পেট পুরে ভাত খেতে পারে না। ও আমি তো ভুলেই গেছিলাম ছেলেটির নাম ছিল বেল্লাল হোসেন। নিজেকে আর কিছুতেই বুঝতে পারলাম না। আমি তখন তৃতীয় শ্রেনির ইংরেজী পড়াই। ক্লাশ শেষ করে বেল্লালকে বাইরে ডেকে নিয়ে আসি। গল্পের ছলে ওকে আমাদের স্কুলের পাশের আমাজেদ চাচার দোকানে নিয়ে যাই। দুজনে আমজাদ চাচার দোকানের সামনের বেঞ্চে এক প্যাকেট বিস্কুট নিয়ে বসি। বেল্লালকে বললাম আসো আমরা একসাথে বিস্কুট খাই। প্রথম ও দুই-তিন বার না না বললেও আমি বার বার বলার পর বেল্লাল আমার অনুরোধ আর ফেলতে পারল না। ক্ষুধার যে কি জ্বালা নিজের চোখে না দেখলে হয়তো বুঝতাম না। চোখের পলকে ও সেই বিস্কুটের প্যাকেট শেষ করে ফেলল। খালি প্যাকেটে হাত দিয়ে আমার মুখের দিকে তাকাল। আমার চোখের পানি তখন আর ধরে রাখতে পারলাম না। চাচাকে বললাম আর এক প্যাকেট বিস্কুট দিতে। ওই প্যাকেটটা ছিড়তেই বলল, ম্যাম আমি অনেক খেয়ে নিয়েছি এবার আপনি খান। আমি আর বেল্লাল দুজনে মিলে বিস্কুট খেয়ে আবার ক্লাশে ফিরে আসি। সে দিনের পর থেকেই গুর-শিষ্যের মধ্যে তৈরী হয়ে গেলো নিবিড় বন্ধুত্ব। এরপর থেকে আমরা প্রতিদিন দুজনে এক সাথে স্কুলে নাস্তা খেতে শুরু করি। কয়েক মাস পর একদিন হঠাৎ বিরতির সময় লাইব্রেরির সামনে এসে দাঁড়ায় বেল্লাল। হাতে ছিল একটি ছোট ব্যাগ। আমি বেল্লালকে ভিতরে আসতে বললাম। কিন্তু খুব সংকোচ ছিল ওর মধ্যে। তারপর ও আমার কাছে আসে এবং একটি বাটি আমার হাতে দেয়। আমি বাটি খুলে দেখি চারখানা রুটি আর সামান্য একটি আলুভাজী। আমি ওর মুখের দিক তাকালে দেখি বেল্লালের চোখ থেকে পানি পড়ছে। আমি জিজ্ঞাস করলাম, কেন কাঁদছ তুমি? উত্তরে আমাকে বেল্লাল বলল, ম্যাম আমরা অনেক গরীব। আপনি কি আমার সাথে নাস্তা করবেন? আমি একগাল হেসে দিলাম এবং ওর বাড়ি থেকে আনা নাস্তা আমরা দুজনে একসাথে খেয়ে নিলাম। বেল্লাল আমাকে ওর নাস্তা খাওয়াতে পেরে খুব খুশি হল। আনন্দে ও আমাকে জড়িয়ে ধরে আবার কেঁদে ফেলল। প্রায় মাস দুয়েক পর দেখি পরপর দুই-তিন দিন স্কুলে আসে না বেল্লাল। ওদের ক্লাসের ছাত্রদের কাছে জানতে চাইলে ওরা বললো বেল্লালের খুব জ্বর এসেছে। ছুটির পর স্কুলের শিক্ষক সালমা আপাকে নিয়ে বেল্লালের বাড়িতে যাই। গিয়ে দেখি বেল্লাল বিছানা থেকে উঠতে পারে না। অভাবের সংসারে ওর নানা অনেক কষ্ট করে ফার্মেসি থেকে কয়েকটা নাপা ট্যাবলেট ছাড়া আর কোন ওষুধ-পথ্যই দিতে পারেনি। ওর নানীর কাছে জানতে চাইলাম, চাচী ওকে ডাক্তার দেখিয়েছেন? বেল্লালের নানী বলল, না মা, কোথা দিয়ে ডাক্তার দেখাব ঠিক মত দুবেলা ভাত খেতে পারি না। ডাক্তার দেখানোর টাকা কোথায় পাব। আমি কিছু টাকা বেল্লালের নানীর হাতে দিয়ে বললাম চাচী ওকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে নিয়ে চিকিৎসা করান। চিকিৎসার জন্য দরকার হলে আমি আপনাকে আরও টাকা দেব। এক সপ্তাহের মধ্যে বেল্লাল সুস্থ হয়ে আবার স্কুলে চলে আসে। দেখতে দেখতে বছর শেষ হয়ে আসল। বেল্লাল বার্ষিক পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করলো। আমি ওর রেজাল্ট দেখে অবাক হয়ে গেলাম। ও তৃতীয় স্থান থেকে প্রথম স্থান অধিকার করে ৪র্থ শ্রেনিতে উর্ত্তীন হয়। সে বছর ৪র্থ শ্রেনিতে আমি ওদের গনিত শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পাই। কিন্তু বিধি কেন যেন বার বার বেল্লাল’র কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। ১২ এ প্রিল ২০১৩ তে বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন সেই নানাও চলে যায় পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে। বন্ধ হয়ে যায় বেল্লালের স্কুলে আসা। জানতে পারি সে স্থানীয় ডিসির হাট বাজারের একটা চায়ের দোকানে ধোয়া মোছার কাজ নিয়েছে। ওদের ক্লাসের আসিফ, রুবেল, ফারুকের সাথে কথা বললে ওরা বলে শর্বরী ম্যাম বেল্লাল এখন কি খাবে। তাই বাধ্য হয়ে মাসে ৫০০ টাকা বেতনে বেল্লাল হানিফ মামার দোকানে কাজ করে। আমি এ ঘটনাটা আর মেনে নিতে পারলাম না। স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির মিটিংএ বিষয়টা তুললাম। প্রধান শিক্ষক স্যারকে সঙ্গে নিয়ে কমিটি যাতে আবার বেল্লালকে স্কুলে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। আর আমি ও পড়াশুনার সকল দায়িত্ব নিতে চাই। বাড়ি এসে বেল্লালের জীবনের সকল কথা আমার বাবা ও মাকে বলি। এবং তাদের সাথে কথা বলে আমি বেল্লালকে আমার বাড়িতে নিয়ে আসি। এরপর আমি আর বেল্লাল প্রতিদিন একসাথে স্কুলে যাই। ২০১৪ সালে বেল্লাল প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় এ+ পেয়ে উত্তীর্ন হয়। ৫ম শ্রেনি পাশের পর আমিই ওকে বিবিচিনি নিয়ামতি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজে ভর্তি করে দেই। সেখানে ও আবার আমার মত আর একজন শিক্ষকের আশ্রয় পায়। তিনি হলেন ওর নতুন স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক অমল কৃঞ্চ দত্ত স্যার। তখন থেকে বেল্লাল অমল স্যারের বাসায় থাকে এবং পড়াশুনা করে। সময়ের পরিক্রমায় আমি আমার চাকুরীতে বদলী হয়ে ঝালকাঠী জেলার নলছিটিতে চলে আসি। নলছিটিতে আমার কর্মস্থল ৩৩ নং নলবুনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সেখান থেকে বদলী হয়ে ১০১নং নান্দিকাঠী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারি শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছি। কিন্তু বেল্লালের সাথে সেই স্মৃতিময় দিনগুলো ভাস্বর হয়ে আছে। অনেক বছর হয়ে গেল বেল্লালের সাথে আমার আর কোন যোগাযোগ নেই। হঠাৎই ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসের কোন একদিন আমি আমার ছেলেকে নিয়ে বরিশাল শিল্পকলায় গিয়েছিলাম। সদর রোড বিবির পুকুরের পাড় দাঁড়িয়ে আমরা ফুচকা খাচ্ছিলাম। কেউ দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো। আমি তাকিয়ে দেখি বেল্লাল। ও এসেছিল ওর দাদীকে নিয়ে ডাক্তার দেখাতে। দাদীকে রেখে ও একটু নিচে নেমেছে ঘুরতে। আর আমাকে দেখেই ছুটে এসেছে আমার কাছে। অনেক বছর পর বেল্লালকে দেখে আমার মনটা আনন্দে ভরে গেল। জিজ্ঞাসা করলাম এখন বেল্লাল কী করো? ও বলল ম্যাম আমি এ বছর এইচ.এস.সি তে এ+ পেয়ে উত্তীর্ন হয়েছি। আপনি যদি আমার জীবনে না থাকতেন তাহলে আমি এতটুকু অগ্রসর হতে পারতাম না। ওর কথাশুনে আমার এই ছোট চাকুরীজীবন সফল ও সার্থক বলে মনে হলো। বেল্লাল তোমার জন্য নিরন্তর শুভ কামনা আলোকিত মানুষ হও আর তোমার মতো দরিদ্র মানুষের দুঃখ ঘোচাতে কাজ করে যাও।
শর্বরী গোমস্তা, সহকারী শিক্ষক,
নান্দিকাঠী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়,
নলছিটি,ঝালকাঠী

মুজিব বর্ষ

Pin It on Pinterest