নওগাঁয় দাদন ব্যবসায়ীর খপ্পরে দিশেহারা গৃহবধূরা

প্রকাশিত: ১০:৩৬ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ৮, ২০২০

নওগাঁয় দাদন ব্যবসায়ীর খপ্পরে দিশেহারা গৃহবধূরা

মোঃ ফিরোজ হোসেন নওগাঁ প্রতিনিধি প্রকাশিত: নওগাঁয় দাদন ব্যবসায়ীর খপ্পরে দিশেহারা গৃহবধূরা গৃহবধু রহিমা বিবি। সাংসারিক কাজের প্রয়োজনে একটি ফাঁকা চেক জমা দিয়ে গত ২০১৬ সালে ৩০ হাজার টাকা দাদন ব্যবসায়ী মিলি দেলোয়ারার কাছ থেকে নেন। প্রতিমাসে তিন হাজার টাকা সুদ হিসেবে এক বছরে ৩৬ হাজার টাকা লভ্যাংশ প্রদান করেন। এছাড়া মুল (আসল) টাকার মধ্যে ১৫ হাজার টাকাও পরিশোধ করেন। এরপর তিনি সুদ বা আসল কোন টাকা দিতে পারেননি। ফলে দাদন ব্যবসায়ী আদালতে রহিমা বিবির নামে চেক ডিজঅনারের মামলা ঠুকে দেন। প্রায় দুই বছর মামলা চলার পর রহিমার বিপক্ষে রায় ঘোষনা হলে ছয়মাসের জেল হয়। ২০১৯ সালের ২০ মে তিনি ৬ মাস জেল হাজত খেটে বেরিয়ে আসেন। আবেগ ও টাকা পরিশোধের দুশ্চিন্তায় স্বামী বাবু ২৫ মে স্টোক করে মারা যায়। গত কয়েকদিন আগে আবারও ১৫ দিনের মধ্যে ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা প্রদানের জন্য রহিমাকে নোটিশ প্রদান করা হয়। এমন কাহিনী শুধু রহিমা বিবির নয়। তার মতো নওগাঁ সদর উপজেলার পিরোজপুর গ্রামের প্রায় ১৫ জন গৃহবধু দাদন ব্যবসায়ীর খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব হারিয়েছেন। কেউ জেল হাজত খাটছেন। আবার কেউ বাড়িঘর বিক্রি করে ঢাকায় চলে গেছেন। দাদন ব্যবসায়ী মিলি দেলোয়ারা বিবির বাড়ি একই গ্রামের গোলাম মোস্তফার স্ত্রী। ভুক্তভোগী গৃহবধু রহিমা বিবি কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন, স্বামীকে হারিয়ে এখন আমি নিঃশ্ব। ছোট ছেলেকে মাদরাসায় পড়াচ্ছি। বড় ছেলে বিয়ে করে আলাদা থাকে। এক মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। এখন চাইলেও সুদের টাকার আর দিতে পারবো না। জেল হাজত খেটেছি ও স্বামী মারা গেছে। অন্যের বাড়িতে কাজ করে দিনপথ চলে। এমন খপ্পর থেকে মুক্তি ও প্রশাসনের কাছে ওই সুদ ব্যবসায়ীর বিচার দাবী করছি। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত প্রায় ২০ বছর আগে নাটোর জেলা থেকে এক ছেলেকে (রানা) নিয়ে এসে পিরোজপুর গ্রামে বসবাস শুরু করেন মিলি দেলোয়ারা। এরপর বিভিন্ন এনজিওতে চাকরি শুরু করেন। এরমাঝে নিজেও একটি এনজিও খুলে বসেন। আর ছেলে রানা নওগাঁ শাখা ‘আইএফআইসি ব্যাংক লি:’ এ চাকরি করছেন কয়েক বছর থেকে। স্থানীয়দের অভিযোগ মা ও ছেলে মিলে গ্রামের অসহায়দের সুযোগ নিয়ে ব্যাংকের ফাঁকা চেকে স্বাক্ষর নিয়ে সুদের উপর টাকা দেন। ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলতে তারাই সহযোগীতা করে থাকেন। ভুক্তভোগীরা সুদের টাকা দিলেও এক সময় ব্যর্থ হন। পরে তারা ফাঁকা চেকে নিজেদের ইচ্ছেমতো টাকার অঙ্ক বসিয়ে ব্যাংক থেকে চেক ডিজঅনার করে আদালতে মামলা ঠুকে দেন। পিরোজপুর গ্রামের রবিউলের স্ত্রী ছেফাতুন, ইসলামের স্ত্রী রেশমা, শাহিন আলমের স্ত্রী বানু আক্তারসহ প্রায় ১৫ জন গৃহবধু তাদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে কয়েকজন জেল হাজত খেটে বেরিয়ে এসেছেন। গৃহবধু ছেফাতুন জেলে আছেন। দাদন ব্যবসায়ী মিলি দেলোয়ারা শুধু মহিলাদের টাকা দিয়ে থাকেন। গরীর ও অসহায়দের সুযোগ নিয়ে উচ্চ সুদে টাকা দিয়ে তাদেরকে জিম্মি করে রাখা হয়েছে বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ। সাইফুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি বাড়ি বিক্রি করে সুদের টাকা পরিশোধ করে ঢাকায় চলে গেছেন। ওই দাদন ব্যবসায়ীর খপ্পর থেকে বাঁচতে প্রশাসনের সুদৃষ্টি কামনা করেছেন ভুক্তভোগীরা। ভুক্তভোগী ছেফাতুনের শাশুড়ি খাইরুন বিবি বলেন, ছেলে বিদেশে প্রতারকের খপ্পড়ে পড়েছে। এদিকে সংসারে টানাপোড়ন। ছেলের বউ দাদন ব্যবসায়ী মিলি দেলোয়ারার কাছ থেকে দুই দফায় ৭৫ হাজার টাকা নেয়। এরমধ্যে ৫ মাসের অগ্রিম ২৫ হাজার টাকা লভ্যাংশ কেটে নিয়ে বউয়ের হাতে ৫০ হাজার টাকা দেয়। এরপর বিভিন্ন এনজিও থেকে টাকা তুলে ৩ লাখ টাকা সুদ দেয়া হয়। তারপরও সুদ ও আসল টাকা শেষ হয়না। পরে ছেলের বউয়ের বিরুদ্ধে তারা ১০ লাখ টাকার চেকের মামলা দিলে গত ৫ মাস থেকে জেলে আছে। আপোষে তারা ৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকার দাবী করে। তারপরও আমরা ১ লাখ ২০ হাজার টাকা দিতে চেয়েছি। ভুক্তভোগী রেশমা বেগম বলেন, দুইটি ফাঁকা চেক দিয়ে ৫০ হাজার টাকা নিয়েছিলাম। লাভের টাকা দিয়েছি। তারপরও ৮ লাখ টাকার মামলা দেয়। মামলায় তিনদিন জেল খেটে জামিনে আছি। স্থানীয় আমিনুল ইসলাম, শহীদুল ইসলাম ও আজাদ হোসেনসহ কয়েকজন বলেন, যারা সুদের উপর টাকা নেয় তারা অত্যান্ত অসহায়। সুদ ব্যবসায়ীরা দরিদ্র পরিবারের মহিলাদের প্রলোভন দিয়ে সুদের উপর টাকা দেয়। সুদের টাকা দিতে পারলেও আসল টাকা যেন আর শেষ হয় না। এভাবে চলতেই থাকে। তারা ফাঁকা চেকে ইচ্ছেমত টাকার অঙ্ক বসিয়ে মামলা দিয়ে হয়রানি করে। এটার একটা ব্যবস্থা হওয়া দরকার। অভিযুক্ত মিলি দেলোয়ার ও তার ছেলে রানা বলেন, আমাদের দক্ষিণ পার-নওগাঁ নামে একটি এনজিও ছিল। সে এনজিও থেকে তারা টাকা নিয়েছে ফাঁকা চেক দিয়ে। তারা টাকা নিলেও দীর্ঘদিনে তা পরিশোধ করেনি। একাধিকবার সালিস হয়েছে। বার বার তাদের তাগাদা দেয়া হয়েছে। তাদের বলেছি সুদ দেয়ার দরকার নাই। আমাদের আসল টাকাটা ফেরত দেন। কিন্তু কোন ভ্রুপেক্ষ করেনি। পরে নিরুপায় হয়ে আমরা আদালতের আশ্রয় নিয়েছি। মুল কথা হচ্ছে-টাকা যেন না দিতে হয়, সে পায়তারা তারা করছেন।


alokito tv

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

Pin It on Pinterest