ঢাকা ৬ মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২৩ বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৩:৫৪ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ১৬, ২০২১
সাইফুর রহমান শামীম ,কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি।।বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যেকার পঞ্চাশ বছরের কূটনৈতিক সম্পর্কের ইতিহাসে এককভাবে যদি কোনও ‘লোয়েস্ট পয়েন্ট’ বা নিম্নতম বিন্দু থেকে থাকে, নিঃসন্দেহে সেটা হল পদুয়া এবং বড়াইবাড়ি-রৌমারীতে দুদেশের সীমান্তরক্ষীদের মধ্যে প্রাণঘাতী সংঘর্ষ।
২০০১ সালের ১৬ থেকে ২০শে এপ্রিল, প্রায় টানা পাঁচদিন ধরে ভারতের বিএসএফ ও বাংলাদেশের বিডিআরের (তখন বিজিবি-র নাম এটাই ছিল) মধ্যে চলেছিল এই সংঘাত। বিএসএফের অন্তত ১৬ জন জওয়ান নিহত হয়েছিলেন, দুজন বন্দি হয়েছিলেন বিডিআর ও স্থানীয় গ্রামবাসীদের হাতে। অন্যদিকে বিএসএফের গুলিতে তিনজন বিডিআর সদস্যও প্রাণ হারান, হামলায় কুড়িগ্রামের বড়াইবাড়ি গ্রামটিও সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়ে গিয়েছিল।
আজ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের সেই অপ্রীতিকর অধ্যায় কুড়ি বছরে পা দিতে চলেছে। সীমান্তরক্ষীদের প্রাণহানির পরও তখন কিন্তু বেশ দ্রুতই উত্তেজনা প্রশমিত করা গিয়েছিল, দিল্লি ও ঢাকার মধ্যে জরুরি আলোচনা সীমান্তে শান্তিও ফিরিয়ে এনেছিল। তবে সেই সংঘাতের রেশ দীর্ঘ দুদশক পরেও কোনও না কোনওভাবে আজও রয়ে গেছে বলে অনেক পর্যবেক্ষকেরই বিশ্বাস।
কিন্তু সেটা কীভাবে?
ভারতে বিএসএফের সাবেক মহাপরিচালক প্রকাশ সিংয়ের যেমন বলতে দ্বিধা নেই, ‘ভারতের ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ারে বিএসএফের জন্য সবচেয়ে অগৌরবের দিন হল বড়াইবাড়ি। একটি হামলায় বিএসএফের ষোলোজন সদস্য একসঙ্গে প্রাণ হারিয়েছেন, এমন ঘটনা কিন্তু কাশ্মীর সীমান্ত বা এলওসি-তেও কখনও ঘটেনি।’
তিনি আরও বলছিলেন, ‘কিন্তু সে ঘটনার মীমাংসা করা হয়েছিল কূটনৈতিকভাবে, সামরিকভাবে নয়। ফলে বাহিনীর মধ্যে একটা বদলা নেওয়ার স্পৃহা রয়ে যেতে পারে, যেটা হয়তো অস্বাভাবিক নয়।’
‘ ‘আর একটা জিনিসও খেয়াল করে দেখবেন, বিএসএফের বিরুদ্ধে যে সীমান্তে গুলি করে বাংলাদেশি নাগরিকদের হত্যা করার অভিযোগ আনা হয়ে থাকে, সেই সব ঘটনাও কিন্তু শুরু হয়েছে বড়াইবাড়ি পর্বের পর থেকেই। আমি দুটোর মধ্যে সম্পর্ক আছে তা বলছি না, কিন্তু বাস্তবতা হল ওই ঘটনার পর থেকেই বিএসএফকে বাংলাদেশে ‘ট্রিগার হ্যাপি’ বলা শুরু হয়েছে।’’
আন্তর্জাতিক সীমান্তের বিতর্কিত গ্রাম পদুয়ার নিয়ন্ত্রণ কোন দেশের হাতে থাকবে, তাকে কেন্দ্র করেই শুরু হয়েছিল এই সংঘাত। বাংলাদেশে তখন স্লোগানও উঠেছিল, ‘পদুয়ার মাটি, বাংলার ঘাঁটি’। তবে সংঘাত কীভাবে দানা বাঁধে তা নিয়ে দুদেশের বক্তব্যে যথারীতি ফারাক আছে।
কিন্তু যা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই, তা হল কারণ বা প্ররোচনা যা-ই হোক, বড়াইবাড়িতেই দুদেশের সীমান্তরক্ষীদের মধ্যে মেশিনগান ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে রীতিমতো একটা যুদ্ধ হয়েছিল। মারা গিয়েছিলেন দুদিকের সেনারাই, ভারতের দিকে প্রাণহানির পাল্লা ছিল অনেক ভারী। পঞ্চাশ বছরের ইতিহাসে সেই প্রথম, আর এখনও পর্যন্ত সেই শেষ।
বর্তমানে প্রয়াত কূটনীতিবিদ সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলি তখন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব, অনেক পরে যিনি দিল্লিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের ভূমিকাও পালন করেছেন দীর্ঘকাল।
‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে সরাসরি দায়িত্ব দিয়েছিলেন এই স্পর্শকাতর বিষয়টির মীমাংসা করার। তখন আমি টানা বেশ কয়েকদিন ধরে দিল্লির সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা টেলিফোনে কথা বলতাম।’
‘দিল্লিতে আমার কাউন্টারপার্ট ছিলেন চোকিলা আয়ার, ভারতের প্রথম মহিলা পররাষ্ট্র সচিব। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন যশোবন্ত সিং। তারাও শান্তি ফেরানোর ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন, ধৈর্য ধরে সব কথা শুনতেন।’
‘ দুপক্ষের আগ্রহেই বিষয়টি তখন শেষ পর্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে মীমাংসা করা সম্ভব হয়’ দিল্লিতে দায়িত্ব পালন করার সময় এই প্রতিবেদককে বলেছিলেন সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলি।
ভারতের ষোলোজন সীমান্তরক্ষী বিদেশি বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে প্রাণ হারানোর পরও এই ইস্যুটি যে কোনও যুদ্ধে গড়ায়নি, বা দুদেশের চার হাজার কিলোমিটারেরও বেশি লম্বা সীমান্তে আর কোথাও কোনও প্রাণহানি বা অভিযান সেটি ছিল অবশ্যই একটি বড় কূটনৈতিক সাফল্য।
দিল্লিতে তখন ক্ষমতায় অটল বিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বে বিজেপির একটি জোট সরকার। বাংলাদেশে শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রীত্বের প্রথম মেয়াদের শেষ দিক চলছে, প্রায় সাড়ে চার বছর আগেই তিনি ভারতের সঙ্গে ঐতিহাসিক গঙ্গা চুক্তি সই করে ফেলেছেন।
বাজপেয়ীর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী হাসিনার ব্যক্তিগত সমীকরণ ও সৌহার্দ্যও সীমান্তে দ্রুত শান্তি ফেরাতে প্রভূত সাহায্য করেছিল।
© স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০২০ Developed By Agragami HOST