ঢাকা ৭ মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২৪ বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বাংলাদেশের সিনেমার একজন পুরোধা ব্যক্তিত্ব, এক অবিস্মরণীয় নাম তারেক মাসুদ (৬ ডিসেম্বর ১৯৫৬- ১৩ আগস্ট ২০১১)।
ভিন্ন ধারার সিনেমা নির্মাণ করে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে তিনি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছেন । প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক,চিত্রনাট্যকার,গীতিকার এবং প্রযোজক তারেক মাসুদ গতানুগতিক বাণিজ্যিক ধারার বাইরে সিনেমা নির্মাণে আগ্রহী ছিলেন এবং এ ব্যাপারে বরাবরই সচেষ্ট থেকেছেন । বাংলা সিনেমায় তিনি প্রবর্তন করেছেন এক নতুন ধারা। দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা এবং সিনেমার প্রতি ভালোবাসার জন্য আমেরিকার বিলাস বহুল জীবন ছেড়ে দেশে থেকে সিনেমা নির্মাণের কণ্টক পথে আমৃত্যু লড়াকু সিনেমাযোদ্ধা হিসেবে নিজেকে যুক্ত রেখেছেন । সিনেমার পর্দায় তিনি সুনিপুণ দক্ষতায় তুলে ধরেছেন সাধারণ মানুষ, তাদের যাপিত জীবন,দ্বন্দ্ব,টানাপোড়েন ,সমাজ ব্যবস্থা , লোকসংস্কৃতি, ধর্ম, তত্ত্ব,মুক্তিযুদ্ধ, রাজনীতি, রাষ্ট্র এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রের নানান অসঙ্গতি । তিনি অভিধা পেয়েছিলেন — বাংলার সত্যজিৎ ।
তারেক মাসুদের পুরো নাম আবু তারেক মাসুদ । তিনি ১৯৫৬ সালের ৬ ডিসেম্বর ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা উপজেলার নূরপুর গ্রামে এক রক্ষণশীল পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর বাবা মশিউর রহমান মাসুদ এবং মা নুরুন নাহার মাসুদ । ভাঙ্গা ঈদগা মাদ্রাসায় তাঁর শিক্ষা জীবন শুরু হয় । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে তিনি স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন ।বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তিনি শিল্প- সংস্কৃতি চর্চায় নিজেকে যুক্ত করেন। ১৯৭৫ সালে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন । ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ থেকে ফিল্ম আ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্স শেষ করেন ।এরপরে তিনি তাঁর প্রথম প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ শুরু করেন ।
আদম সুরত(১৯৮৯),মুক্তির গান(১৯৯৫),মুক্তির কথা ( ১৯৯৬),মাটির ময়না (২০০২),অন্তর্যাত্রা(২০০৬), রানওয়ে (২০১০)এর মতো অসাধারণ সিনেমা তিনি নির্মাণ করেছেন এবং বাংলা সিনেমায় সূচনা করেছিলেন এক নবতর ধারা ।তাঁর অনুপম নির্মাণশৈলীর মাধ্যমে বাংলা সিনেমাকে নিয়ে গিয়েছেন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে । গুণী এ নির্মাতা চলচ্চিত্র বিষয়ক বিভিন্ন প্রবন্ধও লিখেছেন ।বিভিন্ন সময়ে তাঁর লেখা চলচ্চিত্র বিষয়ক ৩৩ টি প্রবন্ধ নিয়ে ২০১২ সালে ‘চলচ্চিত্রযাত্রা’ নামে একটি প্রবন্ধ-গ্রন্থ প্রকাশিত হয় ।
তারেক মাসুদ ও তাঁর জীবনসঙ্গী ক্যাথরিন মাসুদ মিলে ‘অডিওভিশন’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন ।
তিনি পরিচিত ছিলেন ‘সিনেমা ফেরিওয়ালা’ নামে । সিনেমার বিভিন্ন কাজে ক্যাথরিন মাসুদকে নিয়ে তিনি বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামগঞ্জে ঘুরেছেন । স্বল্পদৈর্ঘ্য, প্রামাণ্যচিত্র , আ্যানিমেশন ও পূর্ণদৈঘ্য মিলিয়ে মোট ১৬টি চলচ্চিত্র নির্মাণ করছেন এ চলচ্চিত্রকার ।২০০২ সালে তাঁর পরিচালিত মাটির ময়না সিনেমা কান চলচ্চিত্র উৎসবে ডিরেক্টরস ফোর্টনাইটসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করে । মাটির ময়না বাংলাদেশের প্রথম সিনেমা যা অস্কার পুরস্কারে (Academy Award) সেরা বিদেশী ভাষার ছবি বিভাগে মনোনয়ন পায়।
ক্ষণজন্মা এই ব্যক্তিত্ব ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট তাঁর স্বপ্নের প্রোজেক্ট কাগজের ফুল সিনেমার শুটিং স্পট নির্বাচন করে ঢাকায় ফেরার পথে মানিকগঞ্জের ঘিওরে এক মর্মান্তিক সড়ক দুৃর্ঘটনায় নিহত হন । ২০১২ সালে চলচ্চিত্রে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ বাংলাদেশ সরকার তাকে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত করে । তাঁর ৬২তম জন্মদিনে গুগল ডুডল সম্মাননা প্রদান করে । সিনেমাযোদ্ধা তারেক মাসুদ আমৃত্যু সিনেমাকে ভালোবেসে আপন করে নিয়েছিলেন । তাঁর মননে, পঠন -পাঠনে, যাপিত জীবনের সর্বত্র জুড়ে ছিল সিনেমা। সিনেমা ছিল তাঁর ধ্যান , জ্ঞান, স্বপ্ন ও সাধনা । তরুণ প্রজন্মের তিনি অনুপ্রেরণা । বাংলা সিনেমায় তারেক মাসুদ মুক্তির গান শুনিয়েছেন,তাঁর কর্মের জন্য তিনি সতেজ ফুলের মতো সুগন্ধ ছড়াবেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ।
লেখক: চৈতী চক্রবর্তী, শিক্ষক ও সাংস্কৃতিক কর্মী
© স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০২০ Developed By Agragami HOST