মানিকগঞ্জ পাসপোর্ট অফিস প্রতি মাসে ঘুষের ৩০ লাখ টাকা ভাগবাটোয়ারা

প্রকাশিত: ৩:৪৮ অপরাহ্ণ, আগস্ট ১০, ২০২২

মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি ৮ আগষ্ট

প্রতি মাসে প্রায় ৩০ লাখ ঘুষের টাকা ওঠে মানিকগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস থেকে। এর অর্ধেকেরও বেশি আদায় করা হয় দালালের মাধ্যমে। ঘুষের এই টাকা পরে ভাগবাটোয়ারা করা হয় পাসপোর্ট অফিসের ছোট বড় সব কর্মকর্তাদের মধ্যে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রতিমাসে ৩ হাজার পাসপোর্ট গৃহীতা আবেদন করে আর এসব বেশিরভাগ পাসপোর্ট আবেদন দালালদের মাধ্যমে রফাদফা হয়। প্রতি মাসে প্রায় ৩০ লাখ ঘুষের টাকা তোলা হয়। এছাড়াও রয়েছে পাসপোর্ট নবায়ন কিংবা ভুল সংশোধন বাবদ অবৈধ লেনদেন।

পরে ঘুষের এই টাকা পাসপোর্ট কর্মকর্তারা ছাড়াও কিছু নামধারী সাংবাদিক আনছার সদস্যসহ বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা হয়।

মানিকগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে প্রতি মাসে গড়ে ৩ হাজারের বেশি পাসপোর্টের আবেদন জমা হয়। এর মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি জমা পড়ে দালালের মাধ্যমে। প্রতিটি আবেদনের বিপরীতে পাসপোর্ট কর্মকর্তারা ঘুষ নেন এক হাজার টাকা করে। শুধু এই আবেদন খাত থেকেই প্রতি মাসে ঘুষ আদায় হয় প্রায় ৩০ লাখ টাকা। দালাল আর কর্মকর্তার যোগসাজশে শতকরা ৯০টি পাসপোর্ট আবেদনে ব্যবহার করা হচ্ছে বিশেষ সংকেত। সংকেত অনুসারে দ্রুত সেবা পাচ্ছে পাসপোর্ট গৃহীতারা। পাসপোর্ট অফিসের সামনে গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি কম্পিউটারের দোকান। এসব কম্পিউটারের দোকানের মালিক ও কর্মচারীদের সাথে পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা গড়ে তুলেছেন সিন্ডিকেট।
এসব কম্পিউটারের দোকান ছাড়াও রয়েছে একাধিক দালাল সদস্য। এসব দালালরা সেবা প্রার্থীদের কাছ থেকে অনলাইন আবেদন ফি, ব্যাংক ড্রাফট, পুলিশ ভেরিফিকেশন বাদে পাসপোর্ট অফিসের ঘুষের জন্য এক হাজার টাকা নিয়ে থাকেন। এ ঘুষের টাকা পাসপোর্ট অফিসে পরিশোধ করা হলে সেবাপ্রার্থী সহজেই হয়রানি ছাড়া সেবা পান। প্রতিটি ই-পাসপোর্টের ঘুষের এক হাজার থেকে ৫”শ টাকা চলে যায় পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক নাহিদ নেওয়াজের পকেটে। আর বাকি পাঁচশো টাকা অফিসের কর্মচারী থেকে শুরু করে নির্ধারিত হারে আনসার সদস্যদের পকেটে যায়। তবে বড় ধরণের কোন ভুল থাকলে নির্ধারিত এক হাজার টাকার বাইরে আরো টাকা দিতে হয়। কেউ নিজে থেকে অনলাইনে আবেদন করে অফিসে জমা দিতে গেলে ভুল ধরা থেকে শুরু করে নানা টালবাহানা করেন অফিস কর্তা ব্যক্তিরা। অনেক চেষ্টার পর কেউ নিজ উদ্যোগে আবেদন জমা দিয়ে ছবি তুলতে পারলেও পাসপোর্ট ডেলিভারি পেতে ভোগান্তিতে পড়েন। ফলে এসব হয়রানি ও ভোগান্তি এড়াতে সেবাপ্রার্থীরা দালালদের দ্বারস্থ হচ্ছেন। আর দালালদের কাছ থেকে বাড়তি ঘুষের টাকার আশায় কর্মচারীরাও সেবাগ্রহীতাদের সাথে নানা টালবাহানা করেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক দালাল বলেন, ‘অফিসে সিসি ক্যামেরা থাকায় এখন আগের সিস্টেমে কাজ করা হয় না। নতুন সিস্টেমে কাজ করতে হয়। বাইরে গেট থেকে আমাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ লোকদের কাগজপত্র বিশেষ সংকেত দিয়ে ভেতরে পাঠিয়ে দেই। অফিসে কর্মকর্তাদের ফোন করে নাম-ঠিকানা জানিয়ে দেই। সাধারণ ই-পাসপোর্ট করতে ৬ থেকে সাড়ে ৬ হাজার টাকা নিয়ে থাকি। এর মধ্যে ব্যাংক ড্রাফট ৪ হাজার ২৫ টাকা, অনলাইনে আবেদন ২০০ থেকে ৩০০ টাকা, পরিস্থিতি বুঝে পুলিশ ভেরিফিকেশনে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা দিতে হয়। পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তাদের ১ হাজার টাকা দিতে হয়। আর জরুরি ই-পাসপোর্টের ক্ষেত্রে সাড়ে দশ হাজার নিয়ে থাকি। সেক্ষেত্রে পাসপোর্ট অফিসের কর্মাকর্তাদের একটু বেশি টাকা দিতে হয়
স্থানীয়দের অভিযোগ—পাসপোর্ট করার জন্য নিজে সব কিছু করে নিয়ে গেলে অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ‘এই ভুল’, ‘সেই ভুল’ ধরে হয়রানি করেন। তাই ভোগান্তি থেকে রেহাই পেতে অনেকেই দালালের মাধ্যমে পাসপোর্ট করাচ্ছেন। আর এরই সুযোগে পাসপোর্টের জন‌্য ব্যাংক ড্রাফট বাবদ বাড়তি ২ থেকে ৪ হাজার টাকা নিচ্ছে দালালরা। তবে, এই বাড়তি টাকা থেকে পাসপোর্ট-প্রতি ২ হাজার টাকা চলে যাচ্ছে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পকেটে। পাসপোর্ট অফিসের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী বাড়তি আয়ের লোভে দালালদের সঙ্গে সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন বলেও সেবাপ্রার্থীরা অভিযোগ তুলেছেন।

হরিরামপুর উপজেলার বাল্লা গ্রামের সহিদ বলেন, এটা কোন দেশে বাস করি আমরা। পুরাতন পাসপোর্ট দিয়ে নতুন পাসপোর্ট করাবো তাতেও দালাল ছাড়া হচ্ছে না। প্রায় ৫ মাস ধরে দালাল জনি আমার কাছ ১২ হাজার টাকা নিয়েছে আমার পাসপোর্ট নবায়ন করে দেয়ার জন্য এখন দিনের পর দিন ঘুরাচ্ছে। টাকা ফেরত চাওয়া হুমকি দেয়া হয়েছে বলে তিনি জানান।

সরেজমিনে দেখা গেছে, পাসপোর্ট অফিসের ফটকে সেবাপ্রার্থীদের প্রবেশ করার সময় বিভিন্ন প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়। কিন্তু দালালদের মনোনীত ব্যক্তিরা কোনো রকম বাধা ছাড়াই ভেতরে যাওয়ার অনুমতি পান। অফিস সিসি ক্যামেরার আওতায় থাকায় বিকাল ৫ টার আগে কোনো দালাল অফিসে প্রবেশ করে না। কর্মরত আনছার সদস্য আর দালালদের মধ্যে বন্ধুত্ব সম্পর্ক। অফিস চলাকালীন সময় দালালদের আনাগোনা দেখা যায় অফিসের মুল ফটকে।
এবিষয়ে মানিকগঞ্জ পাসপোর্ট অফিসের সহকারি পরিচালক নাহিদ নেওয়াজের সাথে মুঠোফোনে গত সোমবার একাধিকবার ফোন করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেনি। তবে আজকে ফোন দিলে তিনি বলেন, আমি অফিসে নেই। আমার স্ত্রী অসুস্থ। ঢাকায় আছি। আপনার সাথে পড়ে কথা বলবো।

এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল লতিফ বলেন, যদি অফিসের কেউ অনিয়ম বা অবৈধ লেনদেনের সাথে জড়িত থাকে তাহলে তদন্ত সাপেক্ষে আইনানুগ ব্যাবস্থা নেয়া হবে। অচিরেই দালালদের বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হবে


মুজিব বর্ষ

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

Pin It on Pinterest