এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের ঐচ্ছিক বদলির ব্যবস্থা চালু না থাকায় দিশেহারা

প্রকাশিত: ১০:৪৩ পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ১২, ২০২২

এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের ঐচ্ছিক বদলির ব্যবস্থা চালু না থাকায় দিশেহারা

জিয়াউর রহমান:

সারাদেশের মাধ্যমিক পর্যায়ের এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ সুপারিশের ক্ষমতা এনটিআরসিএ এর হাতে যাওয়ার পর এখন পর্যন্ত তিনটি গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে হাজার হাজার শিক্ষক দেশের এক জেলা থেকে অন্য জেলায় গিয়ে চাকরি করছেন। কিন্তু যাঁরা নিজ বাড়ি থেকে ভিন্ন জেলায় ১০০ কিলোমিটার থেকে ৯০০ কিলোমিটার দূরে গিয়ে শিক্ষকতা নামক ব্রত পালন করছেন তাদের বেলায় কী উত্তর হতে পারে? তাদের কি খাবারের প্রয়োজন নেই? যদি থাকে তবে সেটি কীভাবে ? উল্লেখ্য যে,  আমিও তাঁদের মধ্যে একজন।

মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর ভাষ্যমতে বেতন বৃদ্ধির সাথে সরকারের সক্ষমতার বিষয়টি জড়িত। যদি আর্থিক সক্ষমতা না থাকে, তবে মেনে নিলাম। কিন্তু সরকার বাহাদুর অন্তত দূরবর্তী বদলি প্রত্যাশী এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বাজেটবিহীন ঐচ্ছিক বদলির ব্যবস্থা চালু করতে তো আর্থিক সক্ষমতার প্রশ্ন থাকবে না। তাই সরকার বাহাদুর, রাষ্ট্রযন্ত্র, নীতিনির্ধারক ও সংশ্লিষ্ট যারা রয়েছেন তাঁদের উচিত বেঁচে থাকার জন্য অন্তত বাজেটবিহীন ঐচ্ছিক বদলির সুযোগ প্রদানের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। 

০২১ সালের ১৫ নভেম্বর প্রথম আলো পত্রিকায় “পঞ্চাশ হাজার টাকা বেতনেও চালানো যাচ্ছে না সংসার” ও ২০২২ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি দেশ রূপান্তর পত্রিকায় “মাস চলেনা পঞ্চাশ হাজারেও” শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তখনকার তুলনায় এখন দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। তাহলে এখন কী করে সংসার চালানো যায়? ব্যয় বেড়ে গেছে বহুগুণ কিন্তু আয় বাড়েনি একটুও। বরং আয় কমে গেছে অনেকরই।

মাধ্যমিক পর্যায়ের একজন এমপিওভুক্ত সহকারী শিক্ষক সর্বসাকুল্যে তাঁর প্রারম্ভিক বেতন পান মাত্র ১২৭৫০ টাকা। একটু উপলব্ধি করার চেষ্টা করুন, পঞ্চাশ হাজার টাকাতেও যেখানে সংসার চালানো যায় না সেখানে একজন শিক্ষক কীভাবে মাত্র ১২৭৫০ টাকায় তাঁর সংসার চালাবেন? ধরেই নিলাম যে, শিক্ষকতা যেহেতু পেশা নয়, ব্রত। তাই শিক্ষকদের আমিষের প্রয়োজন নেই, শিক্ষকদের জন্য বিলাসিতাও নয়। তাই নিজ বাড়িতে বাস করে যাঁরা শিক্ষকতা করছেন তারা না হয় কচু পাতা, লাউপাতা, ডাল, ভর্তা দিয়ে মোটা চালের ভাত খেয়ে কোনোমতে জীবন বাঁচাবেন।কেননা স্বল্প বেতনে নিত্যপণ্যের লাগামহীন উর্ধগতিতে ভিন্ন জেলায় চাকরি করা এমপিওভুক্ত শিক্ষকেরা দিশেহারা।

এই স্বল্প বেতনে মাসে কিংবা দুই মাসে মাসে একবার বাড়ি যাওয়া আসা, বাড়ি ভাড়া, খাওয়ার খরচ, মোবাইল ও অন্যোন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয় খরচ বাবদ যে টাকা লাগে তা কোনো কিছুতেই বেতনের সাথে সামঞ্জস্য হচ্ছে না। এখানে কিছুতেই অঙ্ক মেলাতে পারিনা । সরকার বাহাদুর, রাষ্ট্রনেতা, রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক, সুশীল সমাজের কাছে আমার প্রশ্ন ” আপনারা কি অঙ্ক কষে মিলিয়ে দিতে পারবেন আমার আয় ও ব্যয়ের হিসেব?

অন্য সব চাকরিতেই বদলি ব্যবস্থা আছে। এমনকি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিজ উপজেলাতেই নিয়োগ দেওয়া হয় তবুও তাদের বদলি ব্যবস্থা আছে। অথচ এখানে সে বদলি ব্যবস্থাটুকুও নেই। কী নির্মম পরিহাস আমাদের পেশার সাথে! কী দারুণ উপহাস আমাদের শিক্ষার সাথে!

আমি তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে চট্টগ্রাম জেলার দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপের একটি দাখিল মাদ্রাসায় সহকারী শিক্ষক পদে সুপারিশ পেয়ে যোগদান করি চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে। আমার প্রতিষ্ঠান থেকে আমার বাড়ির দূরত্ব প্রায় সাতশো কিলোমিটার। এতদূরে নিয়োগ পেলেও নামমাত্র ১০০০ টাকা বাড়ি ভাড়া আর ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা ছাড়া দুর্গম ও দ্বীপাঞ্চল হিসেবে ঝুঁকি ভাতাটাও পাইনা। প্রতিষ্ঠান থেকেও কোনো সম্মানী দেওয়া হয় না। কেটে কুটে সাকুল্য বেতন আমার ১২৭৫০ টাকাই। যোগদান করার পর ইতিমধ্যেই বাস ভাড়া বেড়েছে দুইবার। আবার আমাকে সাগর পাড়ি দিতে হয় নৌযানে। সে নৌযানের ভাড়াও বেড়েছে তিনবার। আগে আমার একার বাড়ি যাওয়া আসার জন্য ব্যয় হত কমপক্ষে চার হাজার টাকা। এখন তা বেড়ে পাঁচ হাজারের উপর লাগবে। ভোজ্য তেলের দাম বৃদ্ধির পর হোটেলে নাস্তা ও ফাস্ট ফুড জাতীয় খাবারের দামও বেড়েছে

নিত্যপণ্যের দাম ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না কোনোভাবেই। বৈশ্বিক মন্দা, মুদ্রাস্ফীতি ও আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে তাল মিলাতে গিয়ে দফায় দফায় দাম বাড়ানো হচ্ছে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের। দুইগুণ থেকে দশগুণ পর্যন্ত দাম বেড়েছে অনেক পণ্যের। নিম্ন আয়ের মানুষের কী পরিস্থিতি সেকথা বলে বোঝাবার সাধ্য আমার নেই। বরং মাসে পঞ্চাশ হাজার টাকা উপার্জন করা একজন ব্যক্তির সংসারের খরচ যোগাতেও চলে টানাপোড়েন । কয়েক মাস আগের কথা। যখন দ্রব্যমূল্য এত চড়া ছিল না, এখন আবার জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে গেছে কল্পনাতীতভাবে।

ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোতে নিম্ন আয়ের মানুষেরা রান্নায় তেলের ব্যবহার করিয়াছেন অনেকাংশে। কিন্তু জ্বালানি তেলের ব্যবহার কমানোর উপায় নেই। তাই পণ্য পরিবহণ ব্যয় বাড়ছে, কারখানার উৎপাদন খরচ বাড়ছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে প্রয়োজনীয় সব নিত্যপণ্যের দাম। এতকিছুর দাম বাড়লেও আমাদের বেতন কিন্তু একবারও বাড়েনি।

দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতির বাজারে টিকে থাকার জন্য বেতন বৃদ্ধির প্রয়োজন। দেশের এত উন্নয়ন হচ্ছে। মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। পদ্মা নদীর উপর দিয়ে এখন গাড়ি চলছে। কর্ণফুলী টানেলের কাজ প্রায় শেষ, মেট্রোরেল চূড়ান্ত উদ্বোধনের অপেক্ষায়, এক্সপ্রেস ওয়ে হচ্ছে, বড় বড় ফ্লাই ওভার হচ্ছে। আরও কত কী! দেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় উল্লিখিত পদক্ষেপ অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। কিন্তু মানুষের অস্তিত্বের চেয়ে বেশি নয়। কেননা অস্তিত্ব সারসত্তার পূর্বগামী। সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহ বলেছিলেন “ধান দিয়া কী অইব জান যদি না থাকে”। সবকিছুর আগে মানুষের বেঁচে থাকা। মানুষ যদি বেঁচেই না থাকল তবে এতসব উন্নয়ন দিয়ে কী হবে? উন্নয়নের ফলই বা ভোগ করবে কে? তাই রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব তার নাগরিককে বাঁচতে দেওয়া।

ছোটবেলার একটা কথা আজ খুব মনে পড়ছে, আমার গ্রামের একটা ছেলেকে অন্য গ্রামের এক ছেলে মেরেছিল। যে মেরেছিল সে ছেলেটার উপর খুব রাগ আর জেদ চেপে বসেছিল আমাদের। যে মেরেছিল সে বেশ কিছুদিন আর আমাদের গ্রামে আসেনি। তাই একদিন ওদের গ্রামের অন্য একটি ছেলে আমাদের গ্রামে আসলে ওকে ধরে গাছের সাথে বেঁধে যখন মারতে যাব তখন ছেলেটি বলেছিল, ‘আমি কী করেছি’? ‘আমাকে মারছো কেন’? ‘আমার কী অপরাধ’? জবাবে আমরা বলেছিলাম, ‘তোর বাড়ি অমুক গ্রামে?’ ছেলেটি উত্তর দিল ‘হ্যাঁ’। তখন আমরা বলেছিলাম, তোর অন্য কোনো অপরাধ নেই। তোর বাড়ি অমুক গ্রামে এটাই তোর অপরাধ।
তেমনি আমার কাছে মনে হয়, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের উপর জোর করে জুলুম করা হচ্ছে। অপরাধ না করেও অপরাধের সাজা দেওয়া হচ্ছে। আমাদের কী অপরাধ? না কি আমরা নিরুপায় হয়ে এ পেশায় এসেছি এটাই আমাদের অপরাধ? সত্যিই কি আমরা অপরাধী? রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে যারা রয়েছেন তাঁরা কি একথা ভেবে দেখবেন না?

 


মুজিব বর্ষ

Pin It on Pinterest