নাটোরে উৎসব মূখর পরিবেশে পলো দিয়ে মাছ শিকার

প্রকাশিত: ১০:২৪ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ১৭, ২০২০

নাটোরে উৎসব মূখর পরিবেশে পলো দিয়ে মাছ শিকার

এস ইসলাম, নাটোর জেলা প্রতিনিধি।

বিলুপ্তির পথে এক সময়কার চিরচেনা গ্রামবাংলার অপরূপ সৌন্দর্যময় মাছ ধরা যন্ত্র”পলো”। তলাবিহীন কলসির আদলে বাঁশ ও বেতের সংমিশ্রণে ছোট ছোট ছিদ্র রেখে শৈল্পিক সুনিপুণভাবে মাছ ধরার যে যন্ত্রটি তৈরি করা হয়, নাটোরের আঞ্চলিক ভাষায় তার নাম “পলো” বলা হয়।

আহবমান বাংলার অন্যতম উৎসব পলো দিয়ে মাছ ধরা। শীতের শুরুতেই শুরু হয় এই উৎসব। অন্যান্য অঞ্চলের মত নাটোরের নলডাঙ্গা উপজেলার বিপ্রবেলঘড়িয়া ইউনিয়নের হরিদাখলসী গ্রামে কুড়িল বিলে একযুগ পর স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন হরিদাখলসী যুব সংঘের উদ্যোগে গ্রামবাসীর ঐক্যবদ্ধ চেষ্টায় পলই দিয়ে মাছ ধরার উৎসবের আয়োজন করা হয়।

মঙ্গলবার (১৭ নভেম্বর) হরিদাখলসী কুমিল্লা পাড়া কুড়ির বিলে সকাল ১০টায় শুরু হয় এই উৎসব।

এ সময় হরিদাখলসী গ্রামসহ আশেপাশের ইউনিয়নের প্রত্যন্ত এলাকার প্রায় দুই শতাধিক মানুষ উৎসবে মেতে উঠেন। হরিদাখলসী কুড়িল বিলে পলই সহ বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে দল বেঁধে মাছ ধরার দৃশ্য যেন দেখার মতো।

বিলের এক প্রান্ত থেকে সকলে একই সাথে লাইন ধরে লুঙ্গি আটঘাট করে বেধে ‘কাছা’ দিয়ে এক সঙ্গে দল বেধে নান্দনিক ছন্দের তালে তালে ঝপ ঝপাঝপ শব্দে পলো দিয়ে মাছ ধরা শুরু হয় এবং সারিবদ্ধভাবে এগিয়ে যেতে থাকেন সামনের দিকে। অনেকেরই মাথায় থাকতো গামছা বাঁধা। চলে পলো দিয়ে পানিতে একের পর এক চাপ দেওয়া আর হৈ হুল্লোড় করে সামনের দিকে অঘোষিত ছন্দের তালে তালে এগিয়ে যাওয়া। যেন এক নিজস্ব চিরচেনা গ্রামবাংলার অপরূপ সৌন্দর্যময় দৃশ্য।

দলবদ্ধভাবে মাছ শিকারের এ দৃশ্য দেখতে বিলের দুই তীরে ভিড় জমায় উৎসুক হাজারো মানুষ। উৎসবে অংশ নেওয়া লোকদের হাততালি দিয়ে উৎসাহ দেন তীরে অবস্থানরত জনতা।

প্রবীণ মাছ শিকারি ইয়াছিন আলী বলেন, বছরের এই দিনের জন্য অধীর আগ্রহে থাকি। সবাই মিলে একসঙ্গে মাছ ধরার আনন্দটাই আলাদা। দিন দিন পরিবেশ ও আবহাওয়ার কারণে নদী-নালা,খাল-বিল,ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানি হ্রাস এবং অধিকাংশ জলাশয় ইজারা দেয়ায় পলই বাওয়া উৎসব এখন অনেকটাই ভাটা পড়েছে। এছাড়া অভাব-অনটন ক্রমশ গ্রাস করে ফেলছে চিরাচরিত এই গ্রামীণ উৎসবের অতীত ঐতিহ্যকে। এরপরও বছরের এই দিনে সবাই মিলে একযুগ পর অতীতের ন্যায় মাছ ধরার উৎসব পালন করছি।

জানা গেছে, আগে প্রত্যেক গৃহস্থের বাড়িতেই থাকতো দু-একটি পলো। পলো মাছ ধরার কাজ ছাড়াও হাঁস-মুরগী ধরে রাখার কাজেও ব্যবহার হতো। শুকনো মৌসুমে বিশেষ করে পৌষ মাস থেকে শুরু করে চৈত্র মাস পর্যন্ত শুরু হয়ে যেত পলো দিয়ে মাছ ধরার মহড়া। মাছ পড়লেই পলোর ভেতর নাড়া দেয়। এতে বুঝা যায় শিকার এবার হাতের মুঠোয়। তখন পলোটিকে কাদা মাটির সাথে ভালোভাবে চাপ দিয়ে ধরে রাখা হয়, যাতে নিচের কোন দিকে ফাঁক না থাকে। এরপর ওপরের খোলা মুখ দিয়ে হাত ঢুকিয়ে মনের আনন্দে ধরে আনা হতো সেই শিকার।

পুরনো মাছ শিকারিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, পলোয় সাধারণত দেশি মাছই বেশি ধরা পরে। রুই, কাতলা, মৃগেল, চিতল, আইড়, কালিবাউস, বোয়াল, শোল, চিতল, টাকি ও গজার প্রভৃৃতি মাছও ধরা পড়তো। মাছ দিয়ে মালার মতো তৈরি করে কাঁধে ঝুলিয়ে খুশিতে বাগবাগ হয়ে বাড়ি ফিরতেন।

স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন হরিদাখলসী যুব সংঘ এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মোঃ জামিল হায়দার জনি বলেন,গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে গ্রামবাসী প্রচেষ্টায় আমাদের সংগঠন এমন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।

সবুজ বাংলা (বিবিসিএফ এর সদস্য সংগঠন)এর বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক,হুমায়ুন রশিদ পলাশ বলেন,বর্তমানে অনেক খাল বিল ও উন্মুক্ত জলাশয় ভরাট কিংবা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বিভিন্ন নদী-নালা হাওর-বাওর খাল-বিল ভরাট করে গড়ে উঠেছে বসত বাড়ি ও বাজার। কোথাও কোথাও কিছুটা জলাশয় থাকলেও আগের মতো মাছ পাওয়া যায়না এবং আগের অনেক প্রজাতির মাছ বর্তমানে বিলুপ্ত প্রায়। বর্তমানে যেটুকু অবশিষ্ট আছে এর বেশির ভাগের অস্তিত্ব হুমকির মুখে। সে দিন বেশি দূরে নয় হয়তো উন্মুক্ত জলাশয়ে পলো দিয়ে মাছ ধরা শুধু স্মৃতি হয়েই রবে অথবা আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম হয়তো চিনবেই না পলো দিয়ে কিভাবে মাছ ধরতে হয়।

এ বিষয়ে,শাহ্ কৃষি তথ্য পাঠাগারের প্রতিষ্ঠাতা মোঃ জাহাঙ্গীর আলম শাহ বলেন,পলো ছারাও তার পাঠাগারে সাকই,ঠ্যালা জাল, হারকি, খলসুন, চ্যাই,ডাকুন,নলসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম রয়েছে। ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও গবেষনার জন্য বিভিন্ন স্থানে এমন তথ্য পাঠাগার গড়ে তোলা প্রয়োজন।

নলডাঙ্গা উপজেলা মৎস্য অফিসার সঞ্জয় কুমার বলেন,চিরচেনা ঐতিহ্য সংরক্ষণ করা প্রয়োজন এবং অচিরের ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য একটি সংগ্রহশালা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হবে।


মুজিব বর্ষ

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

Pin It on Pinterest