নদ-নদীর ভাঙা গড়ার খেলায় দারিদ্র পিছু ছাড়ছে না কুড়িগ্রামের চরাঞ্চলের মানুষের।।

প্রকাশিত: ১২:১৫ পূর্বাহ্ণ, নভেম্বর ২২, ২০২০

নদ-নদীর ভাঙা গড়ার খেলায় দারিদ্র পিছু ছাড়ছে না কুড়িগ্রামের চরাঞ্চলের মানুষের।।

সাইফুর রহমান শামীম,, কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি।।
নদ-নদীর -ভাংগা গড়ার খেলায় দারিদ্র পিছু ছাড়ছে না কুড়িগ্রামের চরাঞ্চলের ৫ লাখেরও বেশি মানুষের।
এই জেলার উপর দিয়ে বয়ে গেছে ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তিস্তা, দুধকুমার, ফুলকুমারসহ ১৬টি নদ-নদী। এসব নদ-নদীর অববাহিকায় রয়েছে সাড়ে ৪শ’রও বেশি চর। যুগের পর যুগ নদীর ভাঙা-গড়ায় বন্দী হয়ে আছে এসব চরবাসীদের জীবন।

অবস্থাটা এমন যে, কোন চর ভাঙনের কবলে পড়লে সেই চরের বাসিন্দারা সর্বস্ব হারিয়ে আবার নতুন করে বসত গড়ে পাশেরই জেগে ওঠা নতুন চরে। চরাঞ্চলের বালু জমিতে ফসল ফলিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর আগেই ফের ভাঙনে ঘর-বাড়ি জমি-জমা সব কিছুই হারাতে হচ্ছে তাদের। এভাবেই জীবন চক্র চলছে তাদের।

কুড়িগ্রামের চরাঞ্চলের এমনই একজন মোজাম্মেল হক। বয়স ৬০ বছর। নদী যতই দুঃখ দিক না কেনো, নদীর সাথেই যেন জন্মের সম্পর্ক তার, রক্তের সম্পর্কও। নদীর বুকে জেগে ওঠা চরে শিশুকাল, শৈশব, যৌবন পেরিয়ে এখন ৫ সন্তানের জনক তিনি। নদীর পানিতে মাছ আর নদীর জেগে ওঠা চরে জীবিকা নির্বাহ করতে করতেই ৬০ বছর।

১৯৭৬ সালের কথা। মোজাম্মেল হক তখন ১৬ থেকে ১৭ বছরের যুবক। বাপ-দাদার জোতদারী ছিল। কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের বর্তমান রলাকাটার চরে বাড়ি ছিল তাদের। চৌচালা টিনের ঘর, সুপারীর বাগান, গোয়াল ভরা গরু, পুকুর ভরা মাছ ছিল। ভারতের কালাইবাড়ী সীমান্ত হয়ে বাংলাদেশের নাগেশ্বরী উপজেলার নুনখাওয়া সীমানা দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করা ব্রহ্মপুত্র নদ একদিন গড়িয়ে গড়িয়ে তাদের বসত ভিটার নিকটবর্তী হলো। ভাঙন আরো তীব্র হলো। সেই সময়ে নদের প্রখর স্রোত আর তীব্র ভাঙনে একদিন-একরাতেই নিশ্চিহ্ন করে দিলো তাদের বসত ভিটা। ঘর-বাড়ির সামান্য কিছু সরাতে পারলেও বাকি সব গ্রাস করে নিয়েছিল ব্রহ্মপুত্র। তারপর ঠিকানা হয় ব্রহ্মপুত্র নদের বুকে জেগে উঠা নতুন চর পশ্চিমের চরে। সেখানে ৫ থেকে ৬ বছর বাপ-দাদার জেগে ওঠা জমিতে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা। তারপর আবারো বসত-ভিটাসহ ঘর-বাড়ি ভেঙে নেয় ব্রহ্মপুত্র। আবারো ঠিকানা হয় ওই নদের বুকে জেগে ওঠা দক্ষিণের চরে। সেখানে ৩ থেকে ৪ বছর আবারো ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা। তারপর আবারো ভাঙন। স্থান পরিবর্তন হয় একুশের চরে। তারপর দশবিশের চরে, তারপর চারবিশের চরে, তারপর মাঝিয়ালির চর, তিনবিশের চর, জিতুর দাগে। এভাবেই তার জীবদ্দশায় ৯ থেকে ১০ বার এই ভাঙ্গা গড়ার খেলা খেলতে খেলতে বর্তমানে ঠিকানা মিলেছে সেই নদেরই বড়ুয়ার চরে। সেখানেই পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করছেন মোজাম্মেল হক।

একই অবস্থা বর্তমানে ব্রহ্মপুত্রের চর রলাকাটায় বসবাসকারী আনছার আলীর (৬০)। অন্ততঃ ১০ বার ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনে ঘর-বাড়ি সরাতে সরাতে আশ্রয় মিলেছে রলাকাটার চরে। ১০ সন্তানের জনক আনছার আলী তার ৪ মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন চরেই। আর ছেলেদের চরেই বিয়ে করিয়েছেন। বর্তমানে একই চরে পাশাপাশি বসবাস করছেন।

একই অবস্থা আমিনুল ইসলাম, কাইছাল হক, বাছের আলী, ইমান আলীরও। একই অবস্থা এখানের চরাঞ্চলের লাখো পরিবারের। চরাঞ্চলে বসবাসরত এমন কোন পরিবার পাওয়া যাবে না যাদের ঘর-বাড়ি নদ-নদী গ্রাস করেনি। আর তা ৫ থেকে ১০ বারের উপরে। বিশেষ করে ব্রহ্মপুত্র নদের চরগুলোতে বসবাসকারীদের প্রায় প্রত্যেক পরিবারের ঘর-বাড়ী নদের ভাঙনের শিকার হয়েছে ১০ থেকে ১২ বার পর্যন্ত।

জেলার দুর্গম চরাঞ্চলগুলোতে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, যখন একটি চর পুরোটাই ভাঙনের কবলে পড়ে তখন সেই চরে বসবাসরত ১ থেকে দেড়শো পরিবার একই সাথে পার্শ্ববর্তী কোন নতুন চরে বসত গড়ে তোলে। সেখানে নতুন চরের বালু জমিতে কাশবন সরিয়ে নতুন করে শুরু হয় হাড়ভাঙা পরিশ্রম। বালু জমিতে দিনরাত পরিশ্রম করে চিনা বাদাম, কাউন, ধান, ডাল, ভুট্টা, গম, চিনা, সুজি, টিসি, গুজি তিল, তিল, কালিজিরা, ধনিয়া, শালুক, মিষ্টি আলুসহ নানা ফসল চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করতে থাকে। এক সময় ভিটের নতুন লাগানো গাছ বড় হয়। ভিটেতে শাক-সবজি চাষ হয়। হাঁস-মুরগী হয়। হয় দু’একটি গরুও। কিন্তু ঘুরে দাঁড়ানোর এই সময়টাতে আবারো ভাঙনের কবলে সেই চরের মানুষেরা।

এরপর ৩, ৪ অথবা ৫ বছরে হাড়ভাঙা পরিশ্রমে সঞ্চিত সবটুকুই চলে যায় ঘর সরিয়ে অন্য কোন নতুন চরে ভিটে তৈরি আর ঘর মেরামতের পিছনে। নিঃস্ব হতে হয় আবারো। অবশিষ্ট থাকে শুধু দুটি হাত আর নতুন চরের ধু ধু বালু জমি। এ অবস্থায় কিছু পরিবারের প্রাইমারি পাশ করা সন্তানরা কাজের সন্ধানে ঢাকাসহ অন্যান্য বড় শহরে পাড়ি জমালেও সেখানে তাদের শ্রমিকের কাজ ছাড়া আর কিছুই জোটে না। তাদের সামান্য রোজগারে নিজেদের খরচ মেটানোর পর পরিবারের জন্য আর কিছুই করতে পারে না।

চরাঞ্চলের মানুষদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তারা সরকারি বা বেসরকারি কোন রিলিফ চায় না। তারা শুধু নদ-নদীর ভাঙনটাই বন্ধ চায়। তাহলেই তারা চরের বাসিন্দা হয়েও সুখে শান্তিতে বাঁচার স্বপ্ন দেখতে পারবে। তারা জানান, চরের জমি হলেও সেটা নিজের জমি। অন্যত্র যেতে মন চায় কিন্তু সামর্থ্য না থাকায় সে চিন্তা মাথায় এনে লাভ নেই।

জন্ম থেকেই ব্রহ্মপুত্রে অববাহিকায় বেড়ে ওঠা সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের দশবিশের চরের আফসার আলী (৭৫) জানান, ৪০/৪৫ বছর আগে ব্রহ্মপুত্রে দুই দিকে এতো বেশি চর ছিল না। আগে ব্রহ্মপুত্রের একটি মাত্র নদ ছিল যার গভীরতা ছিল অনেক বেশি। ফলে ভারত থেকে নেমে আসা পানি সহজেই নদ বেয়েই গড়িয়ে যেতো। কিন্তু ধীরে ধীরে নদের গভীরতা কমতে শুরু করে। এতে করে বন্যার সময় উজান থেকে নেমে আসা পানি নদ আর বহন করতে পারে না। ফলে এই পানি নদের দু’কুল ছাপিয়ে নতুন নতুন পথ তৈরি করে বিস্তীর্ণ এলাকা ভেঙে নিয়ে যায়। এতে করে অনেক শাখা নদীর সৃষ্টি হয়েছে।

কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. আইয়ুব আলী সরকার বলেন, আমার ইউনিয়নের প্রায় পুরোটাই ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকায় অবস্থিত। এখানে বসবাসকারী সকল মানুষই দারিদ্র সীমার নীচে। একমাত্র ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনের কারণেই তারা ঘুরে দাঁড়াতে পারছেন না। স্থায়ীভাবে ভাঙন রোধ করা গেলে দারিদ্রতা থাকবে না।

দীর্ঘদিন চরাঞ্চল নিয়ে কাজ করা স্থানীয় উন্নয়ন সংস্থা ‘জীবিকা’র পরিচালক মানিক চৌধুরী মনে করেন,


মুজিব বর্ষ

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

Pin It on Pinterest