ঢাকা ২৩ জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৯ মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৮:১৭ অপরাহ্ণ, মার্চ ১৮, ২০২০
মোঃ ফিরোজ হোসেন নওগাঁ প্রতিনিধিঃ আধুনিক যুগের সবার হাতে মোবাইল ফোন, মানে একের মধ্যে সব। এ যুগের ছেলেমেয়েরা কলের গান বা রেডিওর নামটার সাথে পরিচিত নয় । কিন্ত আমাদের ছোটবেলায় গান শোনার বাক্স ছিল একমাত্র কলের গান, যার পোশাকী নাম গ্রামোফোন । আমাদের গ্রামে ইয়াছিন আলীএর বড় সাইজের একটা সুন্দর গ্রামোফোন ছিল । কালো রঙের থালার সাইজের গোলাকার রেকর্ড , রেকর্ড চাপিয়ে পাশের হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে দম দেওয়ার পর একটা দন্ডের সাথে গ্রামোফোনের পিন লাগিয়ে তা রেকর্ডের উপর বসিয়ে দিলেই রেকর্ড ঘোরার সাথে সাথে গান বেজে উঠতো। বড় বাক্সের সাইজের গ্রামোফোনে আবার মাইকে চোঙের মতো চোঙ লাগানো , দেখতে যেন প্রস্ফুটিত ধুতরো ফুলের বড় সংস্করণ।
সাধারণ মানুষেরা বলতো কলের গান । কলের গান নামটার আড়ালে গ্রামোফোন নামটা হারিয়েই গেল একদিন । দু ‘দশ গ্রাম খুঁজেও একটা কলের গান পাওয়া যেত না , আমাদের এলাকায় দুলাল বাবুর কলের গানটি অনেক গ্রামে যেত ,তবে একা নয় সঙ্গে তার মালিকও থাকতো , যাওয়ার কথা যখন উঠল তখন একটা অপ্রাসংগিক কথাও বলে রাখতে চাই ধান বানতে শীত হলেও , সেযুগে গ্রামের গঞ্জ বা হাটবাজারে লন্ড্রি ছিল না , আত্রাই নদীর ওপার থেকে বিশ্বনাথ ধোপা আসতো কাপড়ের বোঝা কাঁধে ঝুলিয়ে, ধোলাই করে ইস্ত্রি করা কাপড় দিয়ে আবার ময়লা কাপড়চোপড় নিয়ে যেত ধোলাই করার জন্যে । লোকে তাকে বিশ্ববাবু বলে ডাকতো । এলাকার বড় বাবুদের কাছে বিশ্ববাবু ধোপার কদর ছিল আলাদা ।তাকে তো ইচ্ছে করলেই পাওয়া যেত না । তাই সেকালের বাবুভায়ারা উনুনে ঘটির তলা গরম করে তা দিয়ে কাঁচা জামাকাপড় ইস্ত্রি করতো , আমাদের প্রতিবেশীর একটা লোহার ইস্ত্রি ছিল । ওটা কলের গানের মতো এ গ্রাম থেকে ও গ্রামে যাতায়াত করতো , কলের গানের মতো ওটার মালিক ওটা সঙ্গে কিন্ত যাওয়া লাগত না ।
তবে ওটা মাঝে মধ্যে হারিয়ে যেত ।আবার আসল কথায় ফিরে আসি ,গ্রামের দিকে কলের গানের একছত্র রাজত্ব ছিল ষাটের দশকের আগ পর্যন্ত । আত্রাই নদীর ওপারে তেঁতুলিয়া আমার বোন জামাইয়ের বাড়িতে একটা কলের গান ছিল । হাইস্কুলে নিচু ক্লাশে পড়াকালে ছুটিছাটায় ওখানে যেতাম । ওখানে গেলে আমার একমাত্র কাজ (!) ছিল কলের গানটা বাজিয়ে শুনা ।তবে তেমন বেশি রেকর্ড ছিল না ,শুধু গান সিনেমার গান ছিল বেশী। সেকালে গ্রামোফোন ছিল ঐতিহ্যের প্রতীক । তারপর গ্রামে এলো রেডিও । হাইস্কুলে পড়াকালে আমাদের তিন ব্যাটারীর একটা মাত্র ট্রান্সিটর রেডিও ছিল । তখন বেলা ১২টার থেকে রেডিও অনুরোধের হতো। তখন কারো রেডিও থাকা মানে বিরাট ব্যাপার ।তখন কুদ্দুস ,আফজাল ছিলেন বাবার বন্ধু মানুষ , আমাদের বাড়িতে এলেন একটা অনুষ্ঠানে রেডিও নিয়ে , অনেক লোকই দেখল আর গান শুনলো । আগে বিয়েতে রেডিও যৌতুক দেওয়া হতো। কিন্ত শোনা হল না কারণ বড় বাসের মাথায় এন্টিনা লাগাতে হবে। গ্রামের আব্দুল মালেক খুব শৌখিন মানুষ একটা ট্রানজিস্টর রেডিও কিনলেন ।
তথনকার দিনে ট্রানজিস্টর রেডিও নিয়ে আত্মীয় বাড়িতে যাওয়া একটা আভিজাত্যের পর্যায়ে পড়তো ।তিনিও আমাদের বাড়িতে এলেন রেডিও নিয়ে লোকজন রেডিওয়ের গান ও খবর শুনতে এক সময় আমাদের বাড়িতে রেডিও এলো । তখন আমি কলেজে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি আত্রাইতে। গরমের ছুটি বাড়ি প্রায় সময়ই রেডিও শুনি ,পড়াশোনায় একটু ,ব্যাঘাত ও ঘটে । সে সময় গ্রামগুলোর মানুষের মধ্যে প্রীতির সম্পর্ক ছিল , সন্ধ্যার পরে আমাদের পাড়ার সমবয়সীরা এক সাথে ব ট্রানজিস্টর নিয়ে বসতাম। টেবিলের ওপর রেডিওতে গান কিংবা খবর হচ্ছে , টেবিলের ওপরেয় রাখা হেরিকেনের আলোতে আঁধার কেটে গেছে । তাই রোজকার খবরের জন্য রেডিওই ভরসা , আর সেটা ১৯৮০ সালের সকল খবর জানার জন্য সবাই উদগ্রীব ।বাংলাদেশ বেতার ঢাকা,রাজশাহী, খুলনা কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শোনতাম। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে রিডিও এর ভূমিকা কথা বলে শেষ করার নয় । শর্ট ওয়েভ রেডিও এর বিবিসি এর বাংলা খবর দিয়েছিল সঠিক খবর । বিবিসি বাংলা বিভাগ মুক্তিযুদ্ধের আগের উত্তাল দিলগুলোর খবর প্রচার করেছিল বস্তুনিষ্ঠ ভাবে , ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ আংশিকভাবে ঔদিন রাতেই প্রচার করে ।
পরদিন সকালের দিকে তত্কালীন রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্র থেকে তা প্রচারিত হয়। আজকের দিনে রেডিও এর জনপ্রিয়তা চরম ভাবে হ্রাস পেলেও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে রেডিও যে অবদান রাখে বলে শেষ করার নয় । সে সময় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার কলকাতায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র স্থাপন কয়ে যুদ্ধে বিশেষ ভূমিকা রাখে । এক সময় রেডিও প্রয়োজনীয়তা কমতে থাকে যখন ভিসিআর বাজারে আসে । ফিতে ওয়ালা ক্যাসেট গানের জগতকে দখল করে নিলেও কম্পাকক্ট ডিস্ক এক সময় ফিতের ক্যাসেটের যুগের সমাপ্তি ঘটল । কম্পিউটার পিসি অনেক এলো তা সাধারণের ধরা ছোঁয়া বাইরে ছিল । তারপর বাজারে এলো মোবাইল ফোন । গান , সিনেমা এবং ভিডিও এখন মানুষের পকেটে । গ্রামোফোনে থেকে মোবাইল ফোনে উত্তরণ এক যুগান্তকারী উলম্ফন ।আর বিলুপ্তি হলো ফিতে ওয়ালা ক্যাসেট সহ রেডিও।
© স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০২০ Developed By Agragami HOST