কুড়িগ্রামে হাজার নৌকার এক ঘাট l

প্রকাশিত: ৩:৩৬ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ২৪, ২০২১

কুড়িগ্রামে হাজার নৌকার এক ঘাট l

সাইফুর রহমান শামীম,, কুড়িগ্রাম।। নৌকা কমে গেছে। ঘাটগুলোও সরগরম নেই আগের মতো। তবে যাত্রী, মাঝি আর দোকানিদের হাঁকডাকে এখনো জমজমাট কুড়িগ্রামের যাত্রাপুর ঘাট। ব্রহ্মপুত্রের এই ঘাটে দিনে হাজার নৌকা নোঙর করে। দেখতে গিয়েছিলেন আব্দুল খালেক ফারুক।

যাত্রাপুর ঘাটে নানা আকারের, নানা রঙের নৌকা আসে। মাছ ধরার ডিঙি নৌকা থেকে শুরু করে পণ্যবাহী বড় বড় মহাজনী নাও। ব্রহ্মপুত্র ভারত থেকে বাংলাদেশে ঢুকেছে যে চরের পাশ দিয়ে, তার নাম অট্টআশির চর। ওপারে আসামের ছালাপাড়া, তিনশ বিঘা, বুদাখার হাট। মুক্তিযুদ্ধের সময়ও এসব হাট থেকে লোকজন আসত যাত্রাপুর হাটে মালামাল নিয়ে। এখন ভগবতীর চর, ইটালুকান্দা, ফকিরের চর, দৈ খাওয়া, আইরমারী, সাহেবের আলগা, জাহাজের আলগা, ঝুনকার চর, কালির আলগা, রলাকাটা, নারায়ণপুর, বারোবিশ, চরকাঁপনা, নুন খাওয়া, শান্তিয়ার চর, মাদারগঞ্জ, কচাকাটা, শৌলমারীসহ ছোট-বড় দুই শতাধিক চর থেকে মালামাল ও যাত্রী আনা-নেওয়ার কাজ করেন মাঝিরা। ব্রহ্মপুত্র, দুধকুমারতীরের এসব চর এলাকায় সড়ক যোগাযোগ নেই। চলাচলের একমাত্র ভরসা নৌকা।

নৌকায় হরেক পণ্য

শনি ও মঙ্গলবার—সপ্তাহের দুই দিন হাট বসে যাত্রাপুরে। হাটবারে পণ্য ও যাত্রী পারাপারে ভিড় বাড়ে ঘাটে। চরে উৎপাদিত ধান, পাট, কাউন, চিনাবাদাম, ডাল, কলাসহ নানা কৃষিপণ্য নিয়ে চরের মানুষ আসে এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় হাট যাত্রাপুরে। চর থেকে গরুও নিয়ে আসে অনেক নৌকা। চরে প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো কাশ নিয়ে নারায়ণগঞ্জ ও দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে যায় কিছু নৌকা। এ ছাড়া নির্মাণসামগ্রী, কৃষি উপকরণ, খড়সহ বিচিত্র পণ্য পরিবহন হয় এই যাত্রাপুর ঘাট থেকে।

ঘাটে মেলার আবহ

শনিবার। দুপুর সাড়ে ১২টা। হাট সবে জমতে শুরু করেছে। ধান, পাট, কাউনসহ নানা কৃষিপণ্য ছাড়াও হাতে হাঁস-মুরগি, কাঁধে বা মাথায় ব্যাগ-বস্তা নিয়ে ঘাট থেকে মানুষ আসছে যাত্রাপুর হাটে। হাট থেকে ঘাটের দূরত্ব প্রায় এক কিলোমিটার। বালুময় চরে বাদামক্ষেতের পাশ দিয়ে ঘাটে পৌঁছে দেখি কয়েক শ নৌকা নোঙর করেছে ঘাটে। নৌকাগুলো মানুষ আর মালপত্রে ভরা। ঘাটের ওপর বসেছে কিছু অস্থায়ী দোকান। মাইকে অনবরত বাজছে ভাওয়াইয়া গান। হাটের কিছু দোকানদার ঘাটেই বসিয়েছেন পণ্যের পসরা। খেলনার দোকানও আছে।

আকবর নাইয়ার ৫০

চরযাত্রাপুরের আকবর আলী। নৌকার মাঝি হিসেবে এই ঘাটে কাটিয়ে দিয়েছেন ৫০ বছর। বাবার সঙ্গে ১৫ বছর বয়সে নৌকার হাল ধরেছিলেন। এখন ছেলেও বাইছে নৌকা। ধার-দেনা আর এনজিওর ঋণে সাড়ে তিন লাখ টাকা দিয়ে নৌকা বানিয়েছেন। সেই নৌকার আয়েই জীবন চলছে কায়ক্লেশে। এই ঘাটের সঙ্গেই বারো মাস সখ্য চরযাত্রাপুরের আব্দুস সামাদের। বলেন, ‘হাটের দিন এই ঘাটে এক হাজার নৌকা আসে। আর কোনো ঘাটে এখন এত নৌকা ভেড়ে না।’

গরুর গাড়ি থেকে ঘোড়ার গাড়ি

একসময় উত্তরের অন্যান্য এলাকার মতো ব্রহ্মপুত্র আর ধরলার তীরের গ্রামে গ্রামে ছিল গরু আর মহিষের গাড়ি। এখানে মনছার গাড়িয়াল, মজনু গাড়িয়াল আর আবু তালেব গাড়িয়ালের মতো অনেকেই গরু-মহিষের গাড়িতে ব্রহ্মপুত্র থেকে ধরলার ঘাটে যাতায়াত করতেন। এখন যাত্রাপুর ও পাশের পাঁচগাছি, ঘোগাদহ ও ভোগডাঙা ইউনিয়নে প্রায় ৩০০ ঘোড়ার গাড়ি চলে। ঘাটে দেখা হয় ছদর উদ্দিনের সঙ্গে। খানাখন্দ আর ভাঙা সড়কে দিব্যি ছুটে চলে তাঁর ঘোড়া। যাত্রী ও পণ্য আনা-নেওয়ার কাজ করেন ঘাটে। জানালেন, এ কাজে দৈনিক আয় ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা।

ঘাটের উত্থান-পতন

ব্রিটিশ জামানায় চরযাত্রাপুর গ্রামের উত্তরে ছিল ব্রহ্মপুত্র নদ। নদের পারেই যাত্রাপুর ঘাট। দক্ষিণে দুই কিলোমিটার দূরে কুড়িগ্রাম শহর হয়ে ট্রেন আসত রেলবাজার স্টেশনে। এখন যা রেলবাজারের চর নামেই প্রসিদ্ধ। ঘাটের পাশেই ছিল বিশাল আকারের বটগাছ। সেই গাছের গোড়ায় বসত গানের আসর। ব্রহ্মপুত্রের আগ্রাসী থাবায় এখন এসব শুধুই স্মৃতি। এখন বর্ষায় একেবারে হাটের কিনারে সরে আসে যাত্রাপুর ঘাট। শত শত নৌকা আসে ব্রহ্মপুত্রের বুকে ঢেউ খেলিয়ে। আর শুকনা মৌসুমে আধাকিলোমিটার চর ভেঙে যেতে হয় ঘাটে। পথের ধুলায় মাখামাখি হয়ে ক্রেতা-বিক্রেতার কাফেলা ছোটে ঘাটে-হাটে।


মুজিব বর্ষ

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

Pin It on Pinterest