পরীমণির সাথে কী হচ্ছে, বিচার নাকি প্রতিশোধ

প্রকাশিত: ৬:৫৭ অপরাহ্ণ, আগস্ট ১৪, ২০২১

পরীমণির সাথে কী হচ্ছে, বিচার নাকি প্রতিশোধ

গত ৪ আগস্ট বাসায় র‌্যাবের অভিযানে আটক হয়েছেন অভিনেত্রী পরীমণি। এরপর মাদক মামলায় দুই দফায় রিমান্ড শেষে গতকাল শুক্রবার আদালতে হাজির করে আর রিমান্ড চাওয়া হয়নি। র্যাবের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতেই পরীমণির বাসায় অভিযান চালানো হয়েছে। কিন্তু এখন পরীর বিষয়টি আর এক জায়গায় সীমাবদ্ধ নেই। তার সাথে জড়িয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) এডিসি গোলাম মোহাম্মদ সাকলায়েন ও একটি ব্যাংকের শীর্ষ স্থানীয় কর্মকর্তার নাম। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন পরীমণি অপরাধী হলে নতুন করে আলোচনায় আসা বাকিরা কী? বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে অনেকেই প্রশ্ন করেছেন, পরীমণির সাথে আসলে কী হচ্ছে, বিচার নাকি প্রতিশোধ।

এ বিষয়ে বর্ষীয়ান সাংবাদিক ও কলামিস্ট আবদুল গাফফার চৌধুরী একটি গণমাধ্যমে লিখেছেন, ‘আমি নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে অভিযোগ পেয়েছি, বোট ক্লাবের প্রেসিডেন্ট আমাদের পুলিশপ্রধান। তারই ভাইস প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে ধর্ষণচেষ্টার মামলা করেছিলেন পরীমণি। সেই মামলার আসামি প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য পরীমণির বিরুদ্ধে অভিযোগ সাজিয়েছেন কি না, সেটাও ভেবে দেখা উচিত।’

একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে ফোন করার প্রসঙ্গ টেনে বর্ষীয়ান এই কলামিস্ট লিখেন, ‘নিজের বাড়িতে অবরুদ্ধ হয়ে ব্যাপার কী জানতে চেয়ে পরীমণি পরিচিত পুলিশ কর্মকর্তা হারুন সাহেবকে ফোন করেছেন। এটাকেও তার বিরুদ্ধে অপপ্রচারের একটা হাতিয়ার করা হয়েছে। মানুষ মাত্রই বিপদে পড়লে পরিচিতজনকে ডাকে বা তার সহায়তা চায়। হারুন সাহেবকে তার কর্মদক্ষতার জন্য দেশের অনেকেই চেনেন। পরীমণি তাকে চেনেন বিধায় টেলিফোন করে থাকলে এমন কী অন্যায় করেছেন?’

তিনি এই ঘটনাকে ষড়যন্ত্র উল্লেখ করে লিখেন, আমি দেশের বুদ্ধিজীবী সমাজ, নারী সমাজ ও নাগরিক সমাজকে এই ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করার জন্য এগিয়ে আসতে অনুরোধ জানাই।’ এরপরই এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ১৭ বিশিষ্ট নাগরিক এক বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, অভিনেত্রী পরীমণি ইস্যুকে কেন্দ্র করে দেশের নব্য ধনিক সমাজের চেহারা ফুটে উঠেছে। আলোচিত এই অভিনেত্রীকে ব্যবহারকারী ওই ধনিক শ্রেণীর মুখোশ উন্মোচনের দাবি জানিয়েছেন তারা।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘চলচ্চিত্র জগতের এক অভিনেত্রীকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের নব্য ধনিক সমাজের যে চেহারা ফুটে উঠেছে তা আমাদের গভীরভাবে চিন্তিত, উদ্বিগ্ন ও ক্ষুব্ধ করেছে। নারীকে বাণিজ্য ও ভোগের পণ্য হিসেবে ব্যবহারের ধারা নানাভাবে পরিপুষ্টি পেয়ে সামাজিক অনাচারের ভোগবাদী সংস্কৃতি প্রবল করে তুলেছে। অর্থ-বিত্ত, প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার অশুভ আঁতাতের প্রতিফল যখন ন্যক্কারজনকভাবে প্রকাশ পেতে শুরু করল, তখন নারীর ওপরই এর দায়ভার অর্পণের বিশাল আয়োজন আমরা প্রত্যক্ষ করছি। পুরুষতান্ত্রিক কূপমণ্ডূক চিন্তার এই দাপট সামগ্রিকভাবে সমাজকে এবং বিশেষভাবে নারীকে নানাভাবে নিগ্রহের শিকারে পরিণত করেছে। আমরা নারীর সাংস্কৃতিক অধঃপতনের শিকার হয়ে ওঠার জন্য যারা দায়ী, যারা এর ইন্ধনদাতা তাদের মুখোশ উন্মোচনের দাবি করছি এবং এই ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে সাংস্কৃতিক সামাজিক আন্দোলন বেগবান করার প্রয়োজনীয়তা সবার সামনে মেলে ধরছি।’

এ দিকে পরীমণিকে আটকের পর চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি থেকে তার সদস্যপদ সাময়িক স্থগিত করা হয়েছে। কিন্তু ধীরে ধীরে পরীর জন্য কথা বলছেন অনেকে। চাচ্ছেন ন্যায়বিচার। ‘জাস্টিস ফর পরীমণি’ লেখা পোস্টার ফেসবুকে শেয়ার করে প্রতিবাদ করছেন অনেকেই।
বৃহস্পতিবার পরিচালক ইস্পাহানি আরিফ জাহানের ফেসবুক ওয়ালে এমন একটি পোস্টার দেখা যায়। এর আগে দেশের প্রখ্যাত গীতিকবি ও সুরস্রষ্টা প্রিন্স মাহমুদ পরীমণিকে ‘টানাহ্যাঁচড়া’ না করার অনুরোধ জানান। তিনি বলেন, ‘যেটুকু অন্যায় সে করেছে তার থেকে অনেক অনেক বেশি শাস্তি সে পেয়ে গেছে। এবার একটু দয়া করেন। আর যদি এখনো মনে হয় তার শাস্তি হয়নি, তবে তিন্নির মতো কাচপুর ব্রিজের ওপর থেকে বস্তায় বেঁধে ছুড়ে ফেলে দেন অথবা তাকে মাটিতে অর্ধেক পুঁতে পাথর নিক্ষেপ করে মেরে ফেলেন। তাও প্রতিদিন এমনভাবে টানাহ্যাঁচড়া করে এমন অপমান একজন সংস্কৃতিকর্মী হিসেবে আর মেনে নিতে পারছি না।’ সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত এক কলামে কান চলচ্চিত্র উৎসব থেকে ফেরা রেহানা মরিয়ম নূরখ্যাত অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধন লিখেছেন, ‘পরীমণির ঘটনা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বহিঃপ্রকাশ।’ বাঁধন লিখেছেন, ‘পরীমণির ক্ষেত্রে মিডিয়া ট্রায়ালের মাধ্যমে যা করা হচ্ছে সেটা ন্যক্কারজনক। এটাই সমাজের আসল চেহারা। এই মিডিয়া ট্রায়ালের কোনো দরকার ছিল না। আমি যদি কোনো অপরাধ করে থাকি, তবে প্রথমে প্রমাণ, এরপর বিচার, শাস্তি।’

পরীমণির জন্য প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধনের আহ্বান করেছেন শ্রাবণ প্রকাশনীর প্রকাশক রবিন আহসান। ফেসবুকে এক পোস্টে তিনি লিখেন, ‘আমি আসলে ২০ জন সাহসী মানুষ চাই শনিবার প্রেস ক্লাবের সামনে, যারা বলবে মেয়েটার প্রতি অন্যায় হচ্ছে…!’ কবি জগদীশ বড়ুয়া পার্থ বৃহস্পতিবার পরীমণির মুক্তি চেয়ে মানববন্ধন করেছেন প্রেস ক্লাবের সামনে। সেই মানববন্ধনের ছবি ছড়িয়ে পড়েছে ফেসবুকে। লেখিকা জান্নাতুন নাঈম প্রীতি লিখেছেন, ‘সে (পরী) প্রতীক সেই জঘন্য সমাজব্যবস্থার যেখানে ঘুষ খাইলে কেউ চরিত্রের প্রশ্নও তোলে না!
লেখক ও নাট্যনির্মাতা মোস্তফা মনন লিখেছেন, ‘পরীমণির ঘটনা এবং আমজাদ হোসেনের ছোটগল্প কাল সকালে-এর অনেক মিল আছে। গল্পে দেখতে পাই, এক পাগলি প্রেগন্যান্ট হয়, পরিবারের সবার চাপাচাপিতে সে বলে দেবে কে দায়ী এবং এই ঘটনা বলবে কাল সকালে। এই খবর সবাই জেনে যায়। এলাকাবাসী, পাশের গ্রামের মানুষ। সন্ধ্যার পর এক এক করে আসতে থাকে পাগলির কাছে, মুদি দোকানদার, স্কুল মাস্টার, পাড়ার বখাটে, মেম্বার। তারা একে একে করে গোপনে আসে, আর নানান উপহার দিয়ে বলে, আমার কথা বলিস না। শেষের দিকে গল্পের একটা করুণ পরিণতি হয়। পাগলিকে একজন বিশ্বাস করতে পারে না। সে মনে করে, পাগলি যদি সকালে বলে দেয়! তাই তাকে পেটে ছুরি মারে, পাগলি মারা যায়। কাল সকালে পাগলি বলতে পারে না তার এই অবস্থার জন্য কে দায়ী। পরীমণির ঘটনার সাথে এই অনেক গল্পের মিল। পরীমণি না জানি কার নাম বলে দেয়! কারা পরীমণির বাসায় যেত! সমাজের উচ্চস্তরের মানুষগুলো সঙ্কটে আছে এবং মারাত্মক ঝুঁকিতে আছে। তারা পরীমণিকে করোনার চেয়ে বেশি ভয় পায়। এই জন্য জীবন্ত বা মুক্ত পরীমণি তাদের জন্য হুমকি।’ অবশ্য পুলিশের পক্ষ থেকে একাধিকবার বলা হয়েছে, আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। অন্যায় করলে শাস্তি হবে, দোষ প্রমাণিত না হলে মুক্তি পাবেন পরীমণি।

সূত্র-নয়াদিগন্ত


alokito tv

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

Pin It on Pinterest