বাল্যবিয়েকে ‘না’ করা কুড়িগ্রামের সেই লড়াকু নার্গিস এর জীবনের গল্প

প্রকাশিত: ২:২৯ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২১

বাল্যবিয়েকে ‘না’ করা কুড়িগ্রামের সেই লড়াকু নার্গিস এর জীবনের  গল্প

সাইফুর রহমান শামীম , কুড়িগ্রাম:  সারডোব আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়। কুড়িগ্রামের চরের আলোচিত শিক্ষালয়। যে চরে বালিকাদের স্বপ্ন ডানা মেলার আগেই বাল্যবিয়ের ঝাপটায় নিভে যায়, অজপাড়াগাঁর সেই স্কুলের নবম শ্রেণির চার দেয়ালে একাই টিকে থাকার লড়াইয়ে নেমেছে লড়াকু নার্গিস নাহার। অসময়ে বিয়ের বাদ্যি বেজে ওঠায় আট সহপাঠিনীর সঙ্গ হারিয়েছে সে। করোনার কাঁটায় ছেদ পড়া শিক্ষাজীবনের বিরতি কাটিয়ে দেড় বছর পর গেল ১২ সেপ্টেম্বর স্কুলে পা রেখে পাশে কোনো বান্ধবীকেই আর পায়নি। এখন ক্লাসে একা হলেও লেখাপড়ার ঘুড়ি ঠিকই ওড়াতে চায় নার্গিস। তাই নতুন করে বুনছে স্বপ্নের ফানুস। তিন-তিনবার বিয়ের প্রস্তাব এলেও বাল্যবিয়ের পিঁড়ি দূরেই ঠেলেছে বাববার। অনড় নার্গিসের কারণে মা-বাবা বাজাতে পারেননি তার বিয়ের সানাই। অথচ তার নবম শ্রেণির বাকি আট সহপাঠিনী বাল্যবধূ হয়ে গেছে গেল দেড় বছরেই। দশম শ্রেণির চার ছাত্রীর তিনজনেরও বিয়ে হয়েছে এই সময়ে।

গত ১৩ সেপ্টেম্বর বিভিন্ন প্রিন্ট পত্রিকায় ‘রইল বাকি এক’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদটি এরই মধ্যে সাড়া ফেলেছে। এর পরই বিভিন্ন গণমাধ্যম নার্গিসকে নিয়ে সংবাদ প্রচার করতে থাকে। অন্ধকারে ডুবে থাকা চরের নার্গিস হঠাৎ উঠে আসে পাদপ্রদীপের আলোয়।
সদর উপজেলার হলোখানা ইউনিয়নে ধরলা নদীর তীরে ভাঙনকবলিত সারডোব গ্রামে রবিবার দুপুরে নার্গিসের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, টিনের ঘরের ছোট্ট বাড়িতে মা-বাবাসহ নার্গিসের বাস। কষ্ট আর দারিদ্র্য খুব কাছ থেকে দেখছে প্রতিক্ষণ। বাবা আব্দুল খালেক পল্লী চিকিৎসক। জমিজিরাত পরিবারটির কাছে এখন ধূসর স্মৃতি। প্রায় সবই ধরলার পেটে। দুই বিঘা জমি দুই মেয়ের বিয়ের খরচ মেটাতে বন্ধক রেখেছেন বাবা। খরা ও বন্যার কারণে বালুকাময় এক বিঘা জমি থেকে ফসল ঘরে তুলতে পারেন না। ভিটাটি ছাড়া সম্পদ বলতে শুধু দুটি ছাগল। গবাদিপশুর চিকিৎসা করে দিনে ২০০-৩০০ টাকা আয় করেন আব্দুল খালেক। এ কারণে নার্গিসের লেখাপড়ায় খরচ ঠিকমতো জোগাতে পারেন না তিনি।

নার্গিস জানান, অষ্টম শ্রেণিতে মাত্র চার মাস প্রাইভেট পড়েছে সে। এসএসসি পাস বাবাই তাকে বাড়িতে পড়ান। অভাবের কারণে এখনো বোর্ডের বই ছাড়া কোনো সহায়ক বই কিনতে পারেনি। তবে যত প্রতিকূলতা থাকুক, স্বপ্নের সীমানা ছুঁতে নার্গিস অনড়। সে চায় লেখাপড়ায় তার বড় দুই বোনকে ছাড়িয়ে যেতে। এ জন্য অনার্স বা ডিগ্রি পাস করে চাকরি করে প্রতিষ্ঠিত হতে চায় সে। মানবিক বিভাগে পড়া নার্গিসের ক্লাস রোল ২। নার্গিস বলে, ‘বড় কোনো স্বপ্ন দেখি না। তবে লেখাপড়া শিখে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই। কারো কাছে যেন আমাকে হাত পাততে না হয়।’

তার বাবা আব্দুল খালেক বলেন, ‘নার্গিসের বিয়ের জন্য তিনটি প্রস্তাব এসেছিল; কিন্তু ওর তাতে মত নেই। বড় দুটি মেয়েকে আলিম পাস করিয়ে বিয়ে দিয়েছি।’
নার্গিসের জ্যাঠা আব্দুল মালেক জানান, যৌতুক প্রথা এখন প্রকট। মেয়ে বড় হলে যৌতুকের অঙ্ক বাড়ে। তাই অল্প বয়সে চরের মেয়েদের বিয়ে হয়।

স্থানীয় ইউপি সদস্য বাহিনুর ইসলাম বলেন, ‘চরে গোপনে বাল্যবিয়ে হয়। শিক্ষক বা জনপ্রতিনিধি কারো নজরে আসে না। কাজিরা কিভাবে যেন বিয়ে পড়িয়ে দেন। বাল্যবিয়ের পর তারা আর স্কুলে আসে না।’ সারডোব আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক ফজলার রহমান বলেন, ‘নার্গিস ভালো ছাত্রী। তাকে সাধ্যমতো সহায়তা করে যাচ্ছি আমরা। যেসব ছাত্রীর বাল্যবিয়ে হয়েছে, তাদের স্কুলে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে।’


মুজিব বর্ষ

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

Pin It on Pinterest