হেনরি ডিরোজিওর ভাষায় ঈশ্বর বা আল্লাহ বলে কিছু ছিলনা, কিন্তু মৃত্যুমুখে……. সোহেল সানি হেনরি ডিরোজিও।

প্রকাশিত: ২:০১ অপরাহ্ণ, মার্চ ২৯, ২০২০

হেনরি ডিরোজিওর ভাষায় ঈশ্বর বা আল্লাহ বলে কিছু ছিলনা, কিন্তু মৃত্যুমুখে……. সোহেল সানি হেনরি ডিরোজিও।
সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্টঃ অবিভক্ত বাংলায় জনজাগরণের ইতিহাসে স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। তাঁর পিতা জাতিতে পর্তুগিজ, আর মা ছিলেন খাঁটি বাঙালি। ১৮০৯ সালের ১৮ এপ্রিল কলকাতায় জন্মনেয়া হেনরি ডিরোজিও দম্ভ করে বলতেন, “মানুষই বড়, আল্লাহ বা ঈশ্বর বলে কিছু নেই। নেই বেহেশত-দোযখ বা স্বর্গ-নরক বলেও কিছু। ডিরোজিওকে এজন্য নাস্তিক বলা হলেও স্বাচ্ছন্দ্যে এটাকে হজম করতেন। নিজেকে প্রগতিবাদী ভাবতেন। তিনি ধর্মীয় কুসংস্কার ভেঙ্গে আধুনিক সমাজ গড়ার স্বপ্ন দেখতেন। সেকালের চিন্তাচেতনাকে পরিত্যাজ্য করতে চান। কেননা সেগুলো পুরনো কুসংস্কার ও ঘুণেধরা। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তরুণ সমাজ গড়তে হবে। চোখ ফেলেন কলকাতার হিন্দু কলেজের ছাত্রদের উপর। আন্দোলনের স্ফূরণ ঘটাতে। ছাত্রদের একদল তাঁর তন্ত্রমন্ত্রে দীক্ষিত হলো। চাই ধর্মহীন আধুনিক সমাজ গঠনে একটি সংগঠন। আদর্শগুরু ডিরোজিও শুরু হলো ভবিষ্যত অঙ্কুরোদমের পরিকল্পিত অধ্যায়। “ইয়ং ক্যালকাটা” নামে সংগঠনের মাধ্যমে। পরে এটি “ইয়ং বেঙ্গল” নামে ভারতবর্ষের সীমানা ছাড়িয়ে পরিচিত হয়ে ওঠে। মানুষ নিজেকে যতবড় প্রতিভাবান, জ্ঞান-পন্ডিতই মনে করুন না কেনো, তা যে ঈশ্বর বা আল্লাহপ্রদত্ত, তা হয়তো কেউ অবচেতন মনে আবার কেউ সচেতন মনেই ভুলে বসেন। হেনরি ডিরোজিওর করুণ পরিণতি সেই সত্যের পক্ষে অঙ্গুলি নির্দেশ করে। মেধা-প্রতিভা ও নেতৃত্বগুণের দাম্ভিকতায় হেনরির মস্তিষ্কে যে মিথ্যার প্রাচীর খাড়া হয়েছিলো, তা কতটা নির্দয়ভাবে ভেঙ্গে পড়ে, সেই নিষ্ঠুরতম অধ্যায় পরে টানবো। মরণঘাতী ভয়াল “করোনা” দুনিয়াদারিকে প্রকম্পিত করে আকাশপানে এখন যে ঈশ্বরের সন্ধান করা হচ্ছে, তিনি নিশ্চয়ই আর কেউ নন, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন। সেই আল্লাহর অস্তিত্বেই বিশ্বাসী ছিলেন না ডিরোজিও। যেদেশে আযান নিষিদ্ধ, সেখানেও পবিত্র আযানের সুমধুর ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয়ে আকাশে-বাতাসে অনুরণনের সৃষ্টির পরও কি সন্দেহ আছে, যে আল্লাহ প্রতিপালক নন, আল্লাহই সবকিছুর নিয়ন্তা নন? ডিরোজিও প্রসঙ্গে লেখার উদ্দেশ্য, তাঁর মতো তথাকথিত প্রগতিবাদী সমাজ সংস্কারকের সংখ্যা গুণতিতে অসংখ্য। শান্তি, শিক্ষা, প্রগতি যদি হয় ধর্মহীন আধুনিকবাদ, তাহলে তার পরিণতিটা কি? অনুসন্ধানী গবেষণা করতঃ কতিপয় স্মরণীয় ব্যক্তির নিষ্ঠুর পরিণতি চোখ পড়লো। এরা “নাস্তিক”। ইশ্বর, আল্লাহ বা সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন না। এমন অনেকের জীবন পরিণতির নিষ্ঠুর উপাখ্যান তুলে ধরবো পরবর্তী লেখায়। অবশ্য মহান আল্লাহর অশেষ কৃপায় “করোনার” থাবার বিষাক্ত হাত থেকে যদি আমার রক্ষা হয়। কলকাতা শহরে হেনরি ডিরোজিওদের পারিবারিক অঢেল প্রতিপত্তি ছিলো। পাঁচ ভাইবোন। বড় ডিরোজিও। এক ভাই ফ্রাংক খারাপ প্রকৃতির লোক হিসাবেই কলকাতাবাসীর কাছে ঘৃণার পাত্র ছিলেন। ছোট ভাই ক্লডিয়াস পড়াশোনার নামে বিদেশ গিয়ে চিরদিনের জন্য উধাও হয়ে যান। বোন সোফিয়ার অকালমৃত্যু হয় কঠিন রোগে। ছোটবোন এমিলিয়া ডিরোজিওর আর্দশবরণ করে ঈশ্বরের অবিশ্বাসী ছিলেন। কলকাতার ডেভিড ড্রামন্ডের “ধর্মতলা অ্যাকাডেমি”তেই হেনরির শিক্ষাজীবন শুরু। স্কুলটির প্রধানশিক্ষকটিই ডিরোজিওর অস্থিমজ্জায় ধর্মহীন কথিত প্রগতির চেতনা ঢুকিয়ে দেন। কোনো ধর্মবিশ্বাসের প্রতি শিক্ষক ডেভিড ড্রামন্ডের মতো ছাত্র ডিরোজিওর শ্রদ্ধা ছিলো না। তবে ছাত্র শিক্ষক অত্যন্ত নিষ্ঠাবান ছিলেন। নাস্তিক হওয়া সত্ত্বেও মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাঁদের বানীকে গ্রহণ করতো কোমলমতি ছাত্ররা। কিশোর বয়সেই হেনরি ডিরোজিও কবিতা লিখেন। তা আবার আবৃত্তি ও অভিনয় করে বিস্মিত করে দেন সহপাঠীদের। মাত্র নয় বছর বয়সে স্থানীয় পত্রিকায় ডিরোজিওর কবিতা প্রকাশিত হয়। তিনি একটি সদাগরি অফিসে কেরানির চাকুরি নিলেও অচিরেই ছেড়ে দেন। কলকাতা ছেড়ে গেলেন ভাগলপুরে মাসির বাসায়। সেখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তার মনে শান্তি এনে দিলো। এখানে বসেই লিখতে শুরু করলেন কবিতা। কলকাতা হতে প্রকাশিত “ইন্ডিয়া গেজেট” পত্রিকায় একটার পর একটা প্রকাশ হতে থাকলো। পত্রিকার সম্পাদক জন গ্রান্টের উৎসাহে ডিরোজিওর শুরু হলো কাব্যরচনা। তিনি রচনা করেন “ফকির অব জাঙ্গিরা” প্রচলিত লোককাহিনী ভিত্তিক কাব্য। কলকাতার হিন্দু কলেজে শিক্ষকতা। ডাক ১৮২৬ সালে ১৭ বয়সে যোগ দিলেন সেই তাতে। ছাত্রদের মধ্যে দর্শন পড়াতেন। ছাত্ররা স্বাধীন চিন্তা ও স্বাধীন মতাদর্শে বেড়ে উঠতে পারে, শিক্ষাদানের মূল লক্ষ্য ছিলো এটা। তার নিজের বাসায় মুক্তচিন্তার আসর বসাতেন। সেখানের বিতর্ক প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা ছিলো। ১৮২৭ সালে ডিরোজিও প্রতিষ্ঠা করেন, “অ্যাকাডেমি অ্যাসোসিয়েশন” বির্তকসভা বসতো এখানে। অদ্ভুত সববিষয় নিয়ে। যেমন, ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে কি নেই? ধর্মবিশ্বাস না আধুনিকবাদ? স্বর্গ নরক আছে কিনা? স্বাধীনতা না পরাধীনতা? বিধবাবিবাহ যুক্তিযুক্ত কিনা? প্রবীন না নবীন? জাতিভেদ ভালো না মন্দ? ইত্যাদি। সাহিত্য, দর্শন, রাজনীতি, ইতিহাস, সংস্কৃতি পাঠ করে যুক্তিতর্ক করতে অ্যাকাডেমির সদস্যরা। ক্রমে পুরনো ধ্যানধারণাকে ত্যাগ করে নতুন চিন্তার স্ফুরণ ঘটতে থাকলো সারা বাংলায়। এরা ঈশ্বরের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে কথা বলতে শুরু করেন বিভিন্নভাবে ধর্মাবলম্বীদের জড়ো করে। ডিরোজিওর দর্শন, “যুক্তিহীন বিশ্বাস মৃত্যুর সমান।” “নিয়তির বিধান প্রাচীন ধ্যানধারণার ফসল।” ফলে সনাতনপন্থী হিন্দুরা শঙ্কিত হয়ে পড়ে। গোঁড়া হিন্দুরা খ্রিস্টানদের ধর্মবিশ্বাসের বিরুদ্ধে আঘাত হানে। হিন্দু খ্রিস্টান উভয় সম্প্রদায় ডিরোজিওর এবং অ্যাকাডেমির সদস্যদের ওপর আঘাত হানতে চায়। ডিরোজিও কৌশল পাল্টে অনেক হিন্দুতরুণকে নিজধর্ম ত্যাগ করিয়ে খ্রিস্টানধর্ম গ্রহণ করান। মুসলিমরা এতে অনুরক্ত হয়নি। অবশ্য ওই সময় মুসলিম তরুণরা লেখাপড়া থেকেই পিছিয়ে ছিলো। ব্রিটিশ শাসকরাও ডিরোজিওর প্রতি খুশী হিন্দুূদের খ্রিস্টানধর্ম গ্রহণ করতে দেখে। হিন্দু কলেজ কর্তৃপক্ষ বিপাকে পড়ে। ডিরোজিও ছাত্রদের দল ভারী করেন। ভয়াবহ অবস্থা তখন। সমসাময়িক লাল বিহারীদের লেখা পড়ে জানা যায়, “সপ্তাহের পর সপ্তাহ তরুণ সিংহেরা গর্জন করতেন এই বলে যে,”হিন্দুধর্ম নিপাত যাক।”
কৃষ্ণমোহনের গ্রন্থে দেখা যায়, হিন্দুধর্মের ন্যায় খ্রিষ্টাধর্মের প্রতিও একটি বিদ্রোহী দল গড়ে ওঠে। কলকাতার ঘুরে খ্রিষ্টানপারদীদের নানাভাবে লোকচক্ষে হেয় প্রতিপন্ন করে তারা। গোঁড়াপন্থি হিন্দু এবং খ্রিস্টান উভয় সম্প্রদায়ের লোকেরাই এবার ডিরোজিওর বিরুদ্ধে মাঠে নামে। কুৎসা রটাতে থাকে তাঁর বিরুদ্ধে। কলকাতা হিন্দু কলেজের অধ্যক্ষ ডি আন্সলেম পড়েন বিপদে। ডিরোজিওর বিষয় হিন্দু কলেজের কমিটির সদস্যরা হুশিয়ারি উচ্চারণ করেন তাঁর সামনে গিয়ে। ১৮৩০ সালের ২৭ মে কলকাতায় আসেন ইংল্যান্ডের আলেকজান্ডার ডাফ নামে একজন পাদ্রী। হিন্দুদের খ্রিস্টধর্মে টানার জন্য খ্রিষ্টধর্মের ওপর তিনি বিভিন্নস্থানে জ্বালাময়ী বক্তৃতা করেন, হিন্দু ধর্মের সমালোচনা করে। তাতে গোটা হিন্দুসমাজ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। চারদিকে প্রতিবাদ। হিন্দু কলেজের অস্তিত্বই তখন হুমকির মুখে। ১৮৩১ সালের ২৩ এপ্রিল এক সভায় ডিরোজিওকে পদচ্যুত করা হয়। কলেজের সুনাম ক্ষুন্ন করা, অস্তিত্ব বিপন্ন করাকে অপরাধ হিসাবে গণ্য করা হয়। ডঃ উইলসনের স্বাক্ষরিত পদচ্যুতিপত্রটির পাল্টা একটা জবাব দেন ডিরোজিও। এরপর ডিরোজিও শিক্ষকতা ছেড়ে ঠিক করলেন সাংবাদিকতায় মন দেবেন। “ইস্ট ইন্ডিয়া” নামে একটি পত্রিকা বের করলেন। কিন্তু অর্থসংকটের মুখে একরকম তাঁকে পথেই বসতে হলো। চরম হতাশা, বিষাদ বেদনার শিকার হয়ে শরীরে অসুস্থবোধ করলেন। হলেন শয্যাশায়ী। রোগশয্যাতেই শুয়ে শুয়ে কর্মীদের কাছে মনের দুঃখে পত্র লিখতেন। তাদের ডেকে মনের দুঃখ বলতেন। বাংলার গণজাগরণে তিনি স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব বটে কিন্তু বরণীয় হয়ে উঠতে পারলেন কেবল মাত্র ধর্মের প্রতি ঈশ্বর বা সৃষ্টিকর্তার প্রতি অস্তিত্বই স্বীকার করতেন না বলে। আবার তাঁর শিষ্যদের মতে, প্রকৃত সত্য হলো।, ডিরোজিওর নিজস্ব কোনো ধর্মবিশ্বাস ছিলো না। কিন্তু শয্যাশায়ী অবস্থায় তাঁর চিন্তাভাবনায় পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। মাত্র ২৭ বছর বয়সে কঠিনতম (প্লেগ) রোগে মৃত্যুটা তো অকাল মৃত্যু। তিনি রোগশয্যায় যখন নিশ্চিত হয়ে গেলেন মৃত্যুর সঙ্গে তিনি যুদ্ধ করে পরাস্ত হচ্ছেন, তখন কয়েক ভক্ত অনুসারীর উপস্থিতিতে বললেন, ঈশ্বরের অস্তিত্ব আমার মাঝেও বিরাজমান। তোমরাও ঈশ্বরের অস্তিত্ব কবুল করে নাও। আমি বলে যাচ্ছি আমি নাস্তিক নই। আমি আস্তিক। ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে বলছি, “হে ঈশ্বর আপনি আছেন, আমি স্বীকার করছি, আমাকে ক্ষমা করুন। অথচ, বাংলার গনজাগরণের প্রাণপ্রদীপটি যে হেনরি ডিরোজিও জ্বালিয়ে ছিলেন, সেই তিনিই কিনা বলতেন, মানুষই বড় কথা, ঈশ্বর বা আল্লাহ বলে কিছু নেই। বেহেশত দোযখ, স্বর্গ নরক বা ধর্ম সম্পর্কে চূড়ান্ত সত্য কি, তাও আমার বোধগম্য নয়” (নাউজুবিল্লাহ)। ১৮৩১ সালের ২৬ ডিসেম্বর মাত্র ২৩ বছর বয়সে মৃত্যুমুখে পতিত হন বাংলার গণজাগরণের স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব হেনরি লইলুভিভিয়ান। পাদটীকাঃ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত বিশ্ববাসী আসুন আমরা শিক্ষা গ্রহণ করি একেকজন ডিরোজিওর পরিণতি থেকে। আর আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি আমাদের আপনিই প্রতিপালক, আপনিই নিয়ন্তা। আমাদের ক্ষমা করে করোনার করালগ্রাস রক্ষা করুন।
 

মুজিব বর্ষ

Pin It on Pinterest