একজন বাঙালির জাপানি হয়ে উঠার গল্প – পি আর প্ল্যাসিড

প্রকাশিত: ১২:৫৬ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২৩, ২০২২

একজন বাঙালির জাপানি হয়ে উঠার গল্প – পি আর প্ল্যাসিড

আলোকিত সময়ঃ ছাইতামা প্রিফেকচারের মুছাসিউরাওয়া স্টেশনের কাছেই আমার সাথে বছর বিশ আগে দেখা হয়েছিলো এক ছেলের সাথে। নাম বলেছিল রহিম। বাড়ি ঢাকা জেলার বাইরে কোথাও। জাপানে নতুন এসেছে দেখেই তা মনে হয়েছিল।

তার সাথে প্রথম দেখায়ই আমার অনেক কথা হয়েছিল। বলেছিল, মালদ্বিপে এক জাপানি মহিলাকে বিয়ে করে তার জাপান আসা হয়েছে। জাপান আসার পর থেকে এখন পর্যন্ত সে কোনো বাঙালির দেখা পায়নি। তাই আমার সাথে দেখা হওয়ায় সে যেন তার কোনো আপন আত্মীয়র দেখা পেয়েছে এমন ভাব করেছিল। এখানে কোনো বাঙালির সাথেই যেহেতু তার পরিচয় নেই তাই আমার কাছে চুপি চুপি অভিযোগ করতে চেষ্টা করছিল। মন খারাপ করে বলেছিল তার স্ত্রী এবং শ্বাশুড়ী দুজনে মিলে তার সাথে খুব খারাপ আচরণ করে। এ থেকে রেহায় পেতে চায় কিন্তু উপায় খুঁজে পাচ্ছে না। আমার সহযোগিতা চায়। পারলে সে স্ত্রী রেখে পালাবে, এমনই ছিল তার কথা।

আমাকে বলল, মালদ্বিপে সে চাকরি করতো এক হোটেলে। সেখানে জাপানি এই মহিলা বেড়াতে গিয়ে রাত যাপন করেছে তার ছোট এক মেয়েকে নিয়ে। সেখানেই তাদের পরিচয়। অল্প কয়দিনে প্রেমের সম্পর্কে গড়ায় তারা। এরপর ভালোবাসা, অতপর বিয়ে।

বিয়ে করার কারণেই রহিম জাপান আসে। (রহিম ছদ্ম নাম)। জাপান আসার কিছুদিন পর থেকে প্রচন্ডভাবে হোমসিকে ভুগতে থাকে। রহিম না পারে জাপানি ভাষা বলতে, না পারে ইংরেজি বলতে। বলা ঠিক নয়, তবু বলি। আমার সাথে প্রথম পরিচয়ে যতোটুকু কথা হয়েছে কথা বলে মনে হয়েছে ঠিকভাবে বাংলাও যেন বলতে পারে না।

রহিমদের বাসা আমার বাসার খুব কাছাকাছি। চাইলেই সাইকেলে আসা – যাওয়া করা যায়। জানালো তার স্ত্রী চায় না যেন সে কোনোভাবে অন্য কোনো বিদেশী বা বাংলাদেশীর সাথে যোগাযোগ করুক বা কথা বলুক। বড়ই অশান্তিতে আছে সে বলল। কথা শুনে মনে হয়েছে তার সাথে আমার মেলামেশা করার দরকার নেই, করলে শেষে ঝামেলা হতে পারে। বিধায় তার ফোন নাম্বার আমি চেয়ে নেই নি। কিন্তু সে আমার নাম্বার নিয়েছিল।

এর কিছুদিন পর কোনো এক গভীর রাতে আমাকে ফোন করে কান্নাকাটি করতে শুরু করেছে। কি হয়েছে জানতে চাইলে বলল, তাকে সাহায্য করতে। তাকে ঘর থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। এই কথা শুনে আমি সাথে সাথে পরিচিত এক জাপানিকে ফোন করে বিষয়টি জানালাম। তাকে বিস্তারিত খুলে বলার পর সে গাড়ি নিয়ে এলো এতো রাতে আমার বাসায়। তখনই দুজন মিলে চলে গেলাম রহিমের বাসার ঠিকানায় তার সাথে কথা বলে তাকে সহযোগিতা করতে। যাবার পর পুনোরায় রহিমের সব কথা শুনে সে যেহেতু তখন রাস্তায় ছিল তাই তাকে নিয়ে তার বাসায় গেলাম। বাসায় গিয়ে নক করলে কোনো ভাবে বাসার গেইট খুলতে চাইছিল না। উল্টো পুলিশের ভয় দেখাচ্ছিল আর বাজে কথা বলছিল। আমরাও ছেড়ে দেবার পাবলিক ছিলাম না। যে কারণে আইনি বিষয়ে ব্যবস্তা নেবার কথা বললে পর তার স্ত্রী এবং শ্বাশুড়ি দুজনেই মিলে ঘরের দরজা খুলে ওরা বাইরে এলো। দেখা এবং কথা হল তাদের সাথে। তাদের সাথে কথা বলে বুঝিয়ে একটা মিমাংসা করে রহিমকে সেই রাতের জন্য বাসায় রেখে এলাম।

এই ঘটনার বছর দেড় বা দুই পর আবার দেখা হলো কাছেই এক ডেপার্টমেন্টাল স্টোরে। সাথে তাদের নতুন বাচ্চা। কথা বলার পর রহিম বলল তারা বেশ ভালো আছে এখন। নতুন বাচ্চা উপলক্ষে একদিন আমাদের দাওয়াত করে খাওয়ালো। এরপর আর দেখা নেই। তারও কয়েকবছর পর আমার অফিসের কাছে হঠাৎ একদিন দেখা হলো। সে এসেছিল হালাল খাবার বাজার করতে কাছেই বাংলাদেশী এক দোকানে।

আমি সেদিন তাকে আমার অফিসে নিয়ে গেলাম। অফিসে বসিয়ে কফি খেতে দিয়ে তার জীবনের গল্প শোনলাম। অনেক কথাই বলল সে তার জীবনের। মনে হয়েছিল রহিমের কথা মালা দিয়ে একখানা বই লেখা যাবে। সেদিন কথা বলে সে চলে গেল। এরপর আর দেখা নেই।

সম্প্রতি একদিন দেখা হলো এক রেল স্টেশনের কাছে। প্রথম দিন সে আমাকে দেখেও না দেখার ভান করে পাশ কেটে চলে গেল। পরে আরেকদিন একই জায়গাতে দেখা হলে জানতে চাইলাম তার দিনকাল কেমন চলছে, কোথায় আছে বা কি করে? বলল একটা জাপানি প্রতিষ্ঠানে আইটির কাজ করে। তার এখন জাপানে থাকতে ভিসার কোনো ধরনের সমস্যা নেই। ইত্যাদি। সময় অভাবে আমি তার সাথে দাঁড়িয়ে বেশি সময় কথা বলিনি সেদিন। চলে গেলাম আমি আমার কাজে।

এরও কয়েকদিন পর আমি যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করি সেখানে এক জাপানি আমার দেশের নাম শুনে জানতে চাইলো কিমুরা সানকে চিনি কিনা? এখন কিমুরা তো হচ্ছে জাপানি নাম। এই নামে আমি অনেককেই চিনি। কিন্তু কিমুরা যে একজন বিদেশি নাগরীক সেটা আমার ধারনা ছিল না। তাই পাল্টা প্রশ্ন করেছিলাম কোন কিমুরা?


মুজিব বর্ষ

Pin It on Pinterest