আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি

প্রকাশিত: ১১:৪৫ পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ১৫, ২০২১

আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মরণে
অন্নদাশঙ্কর রায়

নরহত্যা মহাপাপ, তার চেয়ে পাপ আরো বড়ো
করে যদি যারা তাঁর পুত্রসম বিশ্বাসভাজন
জাতির জনক যিনি অতর্কিত তাঁরেই নিধন।
নিধন সবংশে হলে সেই পাপ আরো গুরুতর,
সারাদেশ ভাগী হয় পিতৃঘাতী সে ঘোর পাপের
যদি দেয় সাধুবাদ, যদি করে অপরাধ ক্ষমা।
কর্মফল দিনে দিনে বর্ষে বর্ষে হয় এর জমা
একদা বর্ষণ বজ্ররূপে সে অভিশাপের।
রক্ত ডেকে আনে রক্ত, হানাহানি হয়ে যায় রীত।
পাশবিক শক্তি দিয়ে রোধ করা মিথ্যা মরীচিকা।
পাপ দিয়ে শুরু যার নিজেই সে নিত্য বিভীষিকা।
ছিন্নমস্তা দেবী যেন পান করে আপন শোণিত।
বাংলাদেশ! বাংলাদেশ! থেকে নাকো নীরব দর্শক
ধিক্কারে মুখর হও। হাত ধুয়ে এড়াও নরক।

আমার পরিচয়
সৈয়দ শামসুল হক

আমি জন্মেছি বাংলায় আমি বাংলায় কথা বলি।
আমি বাংলার আলপথ দিয়ে হাজার বছর চলি।
চলি পলিমাটি কোমলে আমার চলার চিহ্ন ফেলে।
তেরশত নদী শুধায় আমাকে, ‘কোথা থেকে তুমি এলে?’

আমি তো এসেছি চর্যাপদের অক্ষরগুলো থেকে
আমি তো এসেছি সওদাগরের ডিঙার বহর থেকে।
আমি তো এসেছি কৈবর্তের বিদ্রোহী গ্রাম থেকে
আমি তো এসেছি পালযুগ নামে চিত্রকলার থেকে।
এসেছি বাঙালি পাহাড়পুরের বৌদ্ধবিহার থেকে
এসেছি বাঙালি জোড়বাংলার মন্দির বেদি থেকে।
এসেছি বাঙালি বরেন্দ্রভূমে সোনা মসজিদ থেকে
এসেছি বাঙালি আউল-বাউল মাটির দেউল থেকে।

আমি তো এসেছি সার্বভৌম বারোভূঁইয়ার থেকে
আমি তো এসেছি ‘কমলার দীঘি’ ‘মহুয়ার পালা’ থেকে।
আমি তো এসেছি তিতুমীর আর হাজী শরীয়ত থেকে
আমি তো এসেছি গীতাঞ্জলি ও অগ্নিবীণার থেকে।

এসেছি বাঙালি ক্ষুদিরাম আর সূর্যসেনের থেকে
এসেছি বাঙালি জয়নুল আর অবন ঠাকুর থেকে।
এসেছি বাঙালি রাষ্ট্রভাষার লাল রাজপথ থেকে
এসেছি বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর থেকে।

আমি যে এসেছি জয়বাংলার বজ্রকণ্ঠ থেকে
আমি যে এসেছি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে।
এসেছি আমার পেছনে হাজার চরণচিহ্ন ফেলে
শুধাও আমাকে ‘এতদূর তুমি কোন প্রেরণায় এলে?’
তবে তুমি বুঝি বাঙালি জাতির ইতিহাস শোনো নাই-
‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’

একসাথে আছি, একসাথে বাঁচি, আজো একসাথে থাকবোই
সব বিভেদের রেখা মুছে দিয়ে সাম্যের ছবি আঁকবোই।
পরিচয়ে আমি বাঙালি, আমার আছে ইতিহাস গর্বের-
কখনোই ভয় করি নাকো আমি উদ্যত কোনো খড়গের।
শত্রুর সাথে লড়াই করেছি, স্বপ্নের সাথে বাস;
অস্ত্রেও শান দিয়েছি যেমন শস্য করেছি চাষ;

একই হাসিমুখে বাজায়েছি বাঁশি, গলায় পরেছি ফাঁস;
আপোষ করিনি কখনোই আমি- এই হ’লো ইতিহাস।
এই ইতিহাস ভুলে যাবো আজ, আমি কি তেমন সন্তান?
যখন আমার জনকের নাম শেখ মুজিবুর রহমান;

তারই ইতিহাস প্রেরণায় আমি বাংলায় পথ চলি-
চোখে নীলাকাশ, বুকে বিশ্বাস, পায়ে উর্বর পলি।

আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি
নির্মলেন্দু গুণ

সমবেত সকলের মতো আমিও গোলাপ ফুল খুব ভালোবাসি,
রেসকোর্স পার হয়ে যেতে সেইসব গোলাপের একটি গোলাপ
গতকাল আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।

শহিদ মিনার থেকে খ’সে-পড়া একটি রক্তাক্ত ইট গতকাল আমাকে বলেছে,
আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।

সমবেত সকলের মতো আমিও পলাশ ফুল খুব ভালোবাসি, ‘সমকাল’
পার হয়ে যেতে সদ্যফোটা একটি পলাশ গতকাল কানে কানে
আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।

শাহবাগ এ্যভিন্যুর ঘূর্ণায়িত জলের ঝরনাটি আর্তস্বরে আমাকে বলেছে,
আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।

সমবেত সকলের মতো আমারো স্বপ্নের প্রতি পক্ষপাত আছে,
ভালোবাসা আছে- শেষ রাতে দেখা একটি সাহসী স্বপ্ন গতকাল
আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।

এই বসন্তের বটমূলে সমবেত ব্যথিত মানুষগুলো সাক্ষী থাকুক,
না-ফোটা কৃষ্ণচূড়ার শুষ্কভগ্ন অপ্রস্তুত প্রাণের ঐ গোপন মঞ্জরীগুলো কান পেতে শুনুক,
আসন্ন সন্ধ্যার এই কালো কোকিলটি জেনে যাক-
আমার পায়ের তলায় পুণ্য মাটি ছুঁয়ে
আমি আজ সেই গোলাপের কথা রাখলাম, আজ সেই পলাশের কথা
রাখলাম, আজ সেই স্বপ্নের কথা রাখলাম।

আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি,
আমি আমার ভালোবাসার কথা বলতে এসেছিলাম।

এক সেকেন্ডে মাত্র চার ফুট
রবিউল হুসাইন

মানুষেরা নাকি এক সেকেন্ডে চার ফুট হাঁটতে পারে সাধারণত

বারো কোটি মানুষ আমরা
আমরা সবাই একসঙ্গে হাঁটলে মোট আটচল্লিশ কোটি ফুট
অর্থাৎ ষোল কোটি গজ, তার মানে
এক সেকেন্ডে প্রায় নব্বই হাজার নয় শ দশ মাইল
এগিয়ে যেতে পারি

স্বাধীনতা পাওয়ার পর বিশ বছর পার হয়ে গেছে
অথচ আমরা সবাই একই জায়গায় একই বিন্দুতে
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দৌড়িয়ে মরছি সব সময়
এক ইঞ্চিও অগ্রসর হতে পারছি না

ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধুকে ভুলতে বসেছি
‘জয় বাংলা’ নামক দীপ্র বজ্রনির্ঘোষ ভুলতে বসেছি
সাতই মার্চের অতন্দ্র স্বাধীনতার ডাক ভুলতে বসেছি
ভাসানীর আস্সালামু আলাইকুম ভুলতে বসেছি
পাকসেনা, রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস্দের
অমানুষিক অত্যাচারের কথা ভুলতে বসেছি
আমাদের মা-বোনদের
ধর্ষিত হবার কথা ভুলতে বসেছি

‘প্রতিটি বাঙালি মেয়েকে গর্ভবতী করে
খাঁটি পাকিস্তানি সন্তানের জন্ম দেব’ – শুয়োরের বাচ্চাদের
সেই রক্তে-আগুন-জ্বালানো সব কথা ভুলতে বসেছি
আমরা মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধাদের কথা ভুলে গেছি
আমরা স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা ভুলে গেছি

আসলে এতো ভুলো মন নিয়ে
স্বাধীনতা রক্ষা করা যায় না

তা হলে স্বাধীনতাকে কীভাবে রক্ষা করা যায়?
সেকেন্ডে মাত্র চার ফুট খানিক এগিয়ে গেলেই
একে রক্ষা করা যায়

আসুন স্বাধীনতা যুদ্ধকে বুকের মাঝখানে রেখে তাই একসঙ্গে
আমরা সবাই এক সেকেন্ডে চার ফুট পথ এগিয়ে যাই
বন্ধুগণ এক সেকেন্ডে মাত্র চার ফুট খুব বেশি কিছু নয়।

৩২ নম্বর মেঘের ওপারে
আনিসুল হক

আকাশের ওপারে আকাশ,
তার ওপরে মেঘ,
মেঘের মধ্যে বাড়ি—
৩২ নম্বর মেঘমহল।
৩২ নম্বরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আপনি।
আপনার গায়ে ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি,
চোখে কালো মোটা ফ্রেমের চশমা,
হাতে পাইপ।

ছাদের কিনারে সানসেটে উড়ছে কবুতরগুলো।
উঠানে সাইকেল-রিকশা চালাচ্ছে লাল সোয়েটার পরা রাসেল।
পানের ডিব্বা নিয়ে ডাইনিং টেবিলের পাশের গোল টেবিলটাতে সুপারি কাটায় ব্যস্ত আপনার রেণু।
জামাল মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিংয়ের সময় পাওয়া ক্যাপটা পরে আয়নায় তাকাচ্ছেন।
ছাদের ঘরে বেহালা বাজাচ্ছেন কামাল। মেঘে মেঘে ছড়িয়ে পড়ছে বেহালার মূর্ছনা।

আকাশের ওপারে আকাশ, তার ওপরে মেঘ,
মেঘের মধ্যে বাড়ি—৩২ নম্বর মেঘমহল।
সেইখানে দোতলার ঝুল-বারান্দায় দাঁড়িয়ে
পুরু লেন্সের ভেতর থেকে পূর্ণ চোখে তাকিয়ে আপনি দেখছেন…

যেমন করে দেখেছিলেন
একাত্তরের মার্চে ওড়ানো সবুজের মধ্যে লাল সূর্য আর হলুদ মানচিত্রখচিত পতাকা;
যেমন করে তাকিয়ে দেখেছিলেন সত্তরে একাত্তরে রোজ আপনার নির্দেশের অপেক্ষায়
৩২ নম্বর থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকা স্বাধীনতা-পাগল মানুষগুলোকে;
যেমন করে সাতই মার্চের মঞ্চে দাঁড়িয়ে লক্ষ-কোটি চোখে দেখতে পেয়েছিলেন
একটা জাতির জন্মের ফুল ফোটা;
যেন আপনি রিলকে, পৃথিবীর শেষতম কবি যিনি
শিল্পীর মগ্নতা নিয়ে নিরীক্ষণ করেন কী করে কলি থেকে পাপড়ি উন্মীলিত হয়, ফুটে ওঠে ফুল।
আকাশের ওপারে আকাশে
মেঘমহলের ৩২ নম্বরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আপনি তাকিয়ে আছেন—
বারবার দেখেও আপনার আশ মিটছে না;
শিল্পী যেমন ছবি আঁকা শেষ করে ক্যানভাস থেকে দূরে গিয়ে পুরোটা ছবি বারবার করে দেখেন;
লেখা সম্পন্ন হয়ে যাওয়ার পরও রবীন্দ্রনাথ যেমন বারবার পড়তেন তাঁর কবিতা
আর পাণ্ডুলিপিটাকে বানিয়ে ফেলতেন একটা আস্ত শিল্পকর্ম;

তেমনি করে আপনি দেখছেন
আপনার আঁকা ছবিটাকে
দূর থেকে, কিন্তু পূর্ণ চোখে।
তেমনি করে আপনি পড়ছেন আপনার লেখা কবিতাটাকে।
অপার্থিব শিল্পসুষমায় অপরূপ দিব্যকান্তি
আপনি দেখছেন কী রকম জ্বলজ্বল করছে আপনার শিল্পকর্মখানি—
দেখছেন কী রকম করে মাথা উঁচু করে দাঁড়াচ্ছে বাঙালিরা—
দেখছেন কী রকম মুক্ত কণ্ঠে তারা গাইছে আমার সোনার বাংলা—
স্বকণ্ঠে স্বরচিত কবিতা পাঠ করে শোনানোর
কবিজনোচিত উজ্জ্বলতা আর মগ্নতা অবয়বজুড়ে;
ভোরের সোনালি আলোয় কাঁচা-পাকা চুলে স্বর্গীয় দ্যুতি।

রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল আর জীবনানন্দ দাশের পাশে দাঁড়িয়ে আপনি বলছেন,
‘ওই দেখুন, ওই যে আমার কবিতা—
কবিগুরু, ওই যে আপনার সোনার বাংলা,
বিদ্রোহী কবি, ওই যে আপনার জয় বাংলা,
জীবনানন্দ বাবু, ওই যে আপনার রূপসী বাংলা,

ওই তো আমার কবিতা আমার কবিতার নাম বাংলাদেশ,
ওই তো আমার কবিতা আমার কবিতার নাম বাংলাদেশ,
ওই তো আমার কবিতা আমার কবিতার নাম বাংলাদেশ,
চির অপরূপ চির মধুর চির অপরাজেয় বাংলাদেশ।’

আপনি চশমা খুলে হাতে নিলেন,
আপনার উজ্জ্বল চোখ দুটি থেকে গড়িয়ে পড়ল দুফোঁটা অশ্রু।

অনেক নিচে মর্ত্যের এক চার কোনা ঘরে লেখার টেবিলে বসে আছি—
আমার চোখ ভিজে গেল
আমি পাশ-টেবিলে রাখা বাংলাদেশের পতাকাটা বুকে জড়িয়ে ধরে বললাম,
কে বলেছে আপনি নাই, এই তো আপনি আছেন—এইখানে,
সবখানে, সমস্ত বাংলায়—
এইখানে বাংলার লাল ও সবুজে
আমাদের অশ্রু আর ভালোবাসায়,
আমাদের মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার
আর এগিয়ে যাওয়ার অমোঘ মন্ত্রে—
‘মানুষকে দাবায়া রাখতে পারবা না…’


মুজিব বর্ষ

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

Pin It on Pinterest